বেছে বেছে প্রতিবাদ যারা করে তাদেরকে ধিক্কার জানাই: তসলিমা নাসরিন
কে বলেছে বাংলাদেশের মানুষ প্রতিবাদ করতে
জানে না? খুব জানে। এই যে রোজিনা নামের এক সাংবাদিককে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের লোকেরা
হেনস্তা করল। এর প্রতিবাদ করতে তো ঝাঁপিয়ে পড়েছে শিল্পী সাহিত্যিক, সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী,
যদু মধু রাম শ্যাম সকলে। লেখক আনিসুল হককে হাপুস নয়নে কাঁদতেও দেখা গেল। সহকর্মীর জন্য
কেঁদেছেন। এক কাগজে রোজিনা ইসলাম আর আনিসুল হক --দু'জনই লেখেন কিনা। আনিসুল হক আর আমিও
কিন্তু একসময় এক কাগজে লিখতাম। সাপ্তাহিক পূর্বাভাসে। পত্রিকা অফিসে আমাদের দেখাও হতো,
আড্ডাও হতো। আমার ওপর যখন অন্যায়ভাবে অত্যাচার
করলো সরকার, আমাকে দেশ থেকে তাড়ালো, ২৭ বছর আমাকে দেশে ফিরতে দিল না, --- তখন কী করেছিলেন
তিনি? এমন অবিশ্বাস্য ভয়াবহ অত্যাচারের কথা জেনেও তিনি কিন্তু আমার জন্য চোখের জল ফেলেননি। হয়তো আমার সঙ্গে সেই হৃদ্যতা ছিল না, যে হৃদ্যতা
রোজিনার সঙ্গে ছিল। কিন্তু আমার নামটিও একবার কোথাও উচ্চারণ করেছেন বলে শুনিনি। শুষ্ক
চোখেও তো কোনওদিন কোথাও দায়সারাভাবেও বলেননি যে
একজন লেখকের ওপর সরকার অন্যায় করছে। তাহলে আনিসুল হকের চোখের জলের পেছনে ব্যক্তিগত হৃদ্যতা আছে, মানবতা নেই। মানবতা থাকলে সব অত্যাচারিতের
জন্য কাঁদতেন, অথবা নিদেন পক্ষে অন্যায়ের প্রতিবাদ
করতেন।
শুধু আনিসুল হক কেন, বাংলাদেশের কোনও শিল্পী
সাহিত্যিক সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী তো প্রশ্ন করেন
না, সরকার কেন আমাকে দেশে প্রবেশ করতে দেয় না। প্রতিবাদ যে তাঁরা করতে জানেন
না, অথবা করতে ভয় পান, এমন তো নয়। আমাকে কেউ
কেউ বলেছেন, দেশ নষ্ট হয়ে গেছে, ওই দেশে গেলে অত্যাচার করবে, না যাওয়াই ভালো।
ঠিক এভাবে রোজিনাকে কিন্তু কেউ বলেননি,
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নষ্ট হয়ে গেছে, ওখানে গেলে অত্যাচার করবে, না যাওয়াই ভালো। বরং
তাঁরা মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার, এবং অত্যাচারিত না হওয়ার অধিকার দাবি করছেন। প্রতিবাদে কাজও
হয়েছে, অন্যায় যাঁরা করেছেন, তাঁদের বদলি করে দেওয়া হয়েছে।
মাঝে মাঝে আমার নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য
লাগে দেশের একটি ভয়াবহ অন্যায় নিয়ে ২৭ বছর মানুষ কী করে চুপ করে আছে। অথচ ক্ষুদ্র কিছু
অন্যায় নিয়ে চিৎকার করে বেশ গলা ফাটায়। আসলে সরকার আমাকে নির্ভাবনায় নির্যাতন করছে, কারণ জানে দেশের বুদ্ধিজীবীরা অন্য
যে কোনও নির্যাতন নিয়ে মুখ খুললেও এই নির্যাতনটি নিয়ে মুখ খুলবে না।
বেছে বেছে প্রতিবাদ যারা করে, তাদের ধিক্কার
জানাই।
বিঃ দ্রঃ- মত ভিন্ন মত
বিভাগের লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয়
নীতির প্রতিফলন নয়।