বাজার নিয়ন্ত্রণে তথ্যউপাত্তের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা দরকার

ভোজ্যতেলের দাম হঠাৎ
বেড়েছে। রোববার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সভা করে সরকার প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ছয়
টাকা বাড়িয়েছে। ভোজ্যতেল মানুষের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য। গ্রাহকের আয় বৃদ্ধির সঙ্গে
সঙ্গে ভোজ্যতেলের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে সয়াবিন তেল উৎপাদন হয় না বলে
এটি পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। এর বিপরীতে আমাদের অভ্যন্তরীণ যে তেল রয়েছে, যেমন
সরিষা, সূর্যমুখী কিংবা নারিকেল তেল ভোজ্যতেলের চাহিদা পূরণের মতো পর্যাপ্ত নয়।
সমস্যা হলো, আমদানিনির্ভর তেলের বাজার প্রতিযোগিতামূলক নয়।
অল্পসংখ্যক আমদানিকারকের
হাতে সিংহভাগ ভোজ্যতেলের শেয়ার। সিপিডি ২০০৬ সালে একটি গবেষণা করেছিল, সেখানে
প্রায় একশ তেল কোম্পানির নাম পাওয়া গেছে। কিন্তু গবেষণায় বের হয়েছিল, মাত্র ছয়
থেকে ১০টি কোম্পানি মূলত সব নিয়ন্ত্রণ করে। হয়তো দেখা যাবে আমদানিকারক হিসেবে অনেক
কোম্পানির নাম আছে। কিন্তু ওই কয়েকটি কোম্পানিই কলকাঠি নাড়ছে। বস্তুত তারাই
ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।
এসব কোম্পানি তাদের
অবস্থান ব্যবহার করে মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। বাজারে তেলের সরবরাহ ও সরবরাহ
চ্যানেলের নিয়ন্ত্রণও যখন তাদের হাতে তখন সংগত কারণেই প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে ভোজ্যতেল
কিনতে পারছেন না গ্রাহক।
সরকার ভোজ্যতেলের
ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ঘোষণা করে। আলোচনার মাধ্যমে এটি নির্ধারণ করা হয়,
যার মাধ্যমে অনুমান করা হয় নির্ধারিত মূল্যে ভোজ্যতেল বিক্রয় হবে। কিন্তু
পূর্ববর্তী সরকারের ক্ষেত্রে যেমনটা দেখেছি, বর্তমান সরকারের সময়ও তা দেখছি–
বাজারে যারা প্রভাবশালী তারাই কর্তৃত্ব ধরে রেখেছেন। তারা সরকারের মূল্য নির্ধারণ
প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করেন। এমনকি কখনও কখনও সরকার মূল্য নির্ধারণ না করলেও তারা
মূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছেন, তার যৌক্তিক কারণ থাকুক বা না থাকুক। সাম্প্রতিক সময়ে এটাই দেখা
গেছে।
এটি পরিষ্কার হচ্ছে,
বেসরকারি খাতের সদস্যরা বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এমনকি সরকারের চেয়েও শক্তিশালী
হয়ে উঠছেন। সরকারের ক্ষমতা এভাবে ক্রমশ সীমিত হওয়া ভোক্তার স্বার্থের দিক থেকে
আশঙ্কাজনক। এমন মার্কেট এজেন্ট বাজারের জন্য ক্ষতিকর। এ ক্ষেত্রে সরকার তার
কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হচ্ছে।
পূর্ববর্তী শাসনামলে
আমরা দেখেছি, ভোজ্যতেল আমদানিকারকদের সঙ্গে সরকারের এক ধরনের সখ্য থাকে। সরকারও
রাজনৈতিক বিবেচনায় তাদের পরিপোষণ করে। তারা পণ্য সরবরাহে সরকারের আনুকূল্য পেয়ে
থাকে। বর্তমান সময়ে সেটি কমে এলেও এখনও সে ধরনের ‘ডমিনেন্ট মার্কেট প্লেয়ার’
বাজারে বিদ্যমান। আগের সরকারের আমলে কয়েকবার চেষ্টা হয়েছিল ভোক্তা অধিদপ্তরকে
ব্যবহার করার। প্রতিযোগিতা কমিশনকেও কিছুট ব্যবহার করা হয়েছিল। আমরা দেখেছি,
প্রতিযোগিতা কমিশন বাজার পর্যবেক্ষণ করে ঘাটতির জন্য দায়ী বিষয়গুলো বের করে এনে প্রতিবেদন
দিয়েছিল। তবে সেই প্রতিবেদনের আলোকে কতটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, আমরা জানি না। কারও
কারও বিরুদ্ধে অর্থদণ্ড হয়েছিল বটে, সামগ্রিক ক্ষতির বিপরীতে সেই অর্থদণ্ড ছিল
খুবই নগণ্য। সেই অর্থদণ্ড বাস্তবায়ন হয়েছিল কিনা, তাও আমরা জানি না। মোট কথা,
বাজারে প্রতিযোগিতামূলক কাঠামো নিশ্চিত করতে যেসব প্রতিষ্ঠান দেশে রয়েছে, সেগুলো
বৃহৎ আকারের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রায় অসহায়।
বাজার মনিটরিংয়ের
ক্ষেত্রেও এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের তথ্যউপাত্তে ঘাটতি আছে। ফলে আইনগত জটিলতায় দেখা
যায়, এ ধরনের প্রতিষ্ঠান কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারে না। আবার বেসরকারি খাতের সঙ্গেও
তাদের এক ধরনের অলিখিত বোঝাপড়া আছে। বিশেষ করে প্রতিযোগিতা কমিশনের সে ধরনে
আন্ডারস্ট্যান্ডিং আছে বলেই আমরা জানি। সে কারণে তাদের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো অবস্থান
নেওয়া যায় না।
আমরা মনে করি, বাজার
ব্যবস্থায় সুশাসন আনা অতি জরুরি। যেহেতু বাংলাদেশের বাজার দিন দিন বড় হচ্ছে,
যেখানে এভাবে অল্প কয়েকজন ‘মার্কেট এজেন্ট’ যদি বাজারকে প্রভাবিত করেন এবং সরকার
যদি অসহায়ত্ব বোধ করে সেখানে ভোক্তা আগামী দিনগুলোতে আরও সংকটে পড়বে।
বাজারে সুশাসন
প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের আরও শক্ত অবস্থান নেওয়া প্রয়োজন। এসব ক্ষেত্রে
অর্থদণ্ড এবং আরও অপরাধমূলক হলে তার আলোকে শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার। তবে এ ধরনের
উদ্যোগ মোটেই দীর্ঘমেয়াদি নয়।
দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগের
জন্য বাজার-সংক্রান্ত তথ্যউপাত্তের স্বচ্ছতা দরকার। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত আমরা
নিশ্চিত হতে পারিনি, বাজারে কী পরিমাণ পণ্যের চাহিদা আছে। ভোজ্যতেলের মাস, এলাকা
কিংবা ঋতুভিত্তিক চাহিদা আমাদের এবং সরকারেরও জানা থাকা দরকার। এ ধরনের তথ্য
কিন্তু বেসরকারি আমদানিকারকদের কাছে আছে। এসব তথ্য যাতে তারা সরকারকে দিতে বাধ্য
থাকে, সে জন্য আইনি সংস্কার দরকার। একই সঙ্গে কত মূল্যে এলসি খোলা হচ্ছে, কত
মূল্যে তা পরে বিক্রি করা হচ্ছে, সেই তথ্যউপাত্তও যাতে নিয়মিত সরকার পায়, সে জন্য
একটি ডিজিটাল সিস্টেম থাকা দরকার।
ডিজিটাল এই মার্কেটিং
সিস্টেমে আমদানি বা উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যায়ে যত এজেন্ট রয়েছেন, তাদের কার কাছে
কেমন স্টক থাকে, কে কী মূল্যে কিনছেন এবং কত বিক্রি করছেন, তার সবই সরকারের কাছে
থাকতে হবে এবং সরকার যাতে সেভাবে ট্র্যাক করতে পারে। এ ধরনের সিস্টেম গড়া সহজসাধ্য
নয়। সে জন্য আমরা বলেছি, নিত্যপ্রয়োজনীয় যে ১৭টি পণ্য রয়েছে, তার সব না হলেও পাঁচ
থেকে সাতটি পণ্যে তা যেন করা হয়। তিন বছরের টার্গেট নিয়ে এভাবে পুরো সাপ্লাই
চেইনকে ডিজিটাল করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
সাপ্লাই চেইনের
ক্ষেত্রে আমদানিকারকদের পরে যারা আছেন, যেমন আড়তদার বা ডিস্ট্রিবিউটর, তারা
আমদানিকারকদের কারণে এক ধরনের হুমকির মুখে থাকেন। যে মূল্য আমদানিকারকরা নির্ধারণ
করে দেন তারা এর বাইরে গিয়ে বিক্রি করতে অসহায় হয়ে পড়েন। এমনকি ক্রয় রসিদেও অনেক
সময় পরিপূর্ণ কিংবা সত্য তথ্য থাকে না। কারণ এতে তার এজেন্সি হারানোর ভয় থাকে। সে
জন্য আইনের সংস্কারে তাদেরও ঢুকাতে হবে এবং প্রতিযোগিতামূলক করতে হবে, যাতে
সাপ্লাই চেইনে একজন ডিলার কেবল একটি কোম্পানির পণ্যই সাপ্লাইয়ে বাধ্য না থাকেন।
বাজার মনিটরে ক্লোজ অপারেশন দরকার। কেবল একবার বসে কিছু ডিউটি কমিয়ে দিলে ভোক্তা
লাভবান হন না।







