হেফাজতের নতুন কৌশল
হেফাজতে ইসলামি বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটি
বিলুপ্তি ঘোষণা করেছেন দলটির (সংশ্লিষ্টরা অরাজনৈতিক সংগঠন বলেন) আমির জুনায়েদ বাবুনগরী।
সেই সুবাদে হেফাজতে ইসলামি নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে, তবে কয়েক ঘণ্টার জন্য। সূর্যের আলো
দেখার আগেই বাবুনগরী দলটির আহ্বায়ক হিসেবে নিজের নাম ঘোষণা করেন। তাঁর সঙ্গী হিসেবে
আরও চার জনের নামও ঘোষণা করা হয় ১২ ঘণ্টা হওয়ার আগেই। গণমাধ্যম মধ্যরাত থেকেই বাবুনগরীর
ঘোষণাকে শীর্ষে স্থান দিতে থাকে। পরের ঘটনাগুলোও ফলাও করে প্রচার করে। বিশেষ করে সামাজিক
যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয় রাতের দ্বিপ্রহর থেকেই।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত মন্তব্যগুলো
পড়ে মনে হতে পারে, হেফাজত বুঝি ভেঙে পড়েছে। মেরুদণ্ড বুঝি নিঃশেষ হয়ে গেছে। বাস্তবে
কি তাই?
আসলে হেফাজত নাটাই থেকে ডোর ছাড়ছে মাত্র।
ঘুড্ডি একটু নেতিয়ে পড়ছে শুধু। এদিক-ওদিক একটু গোত্তা খাচ্ছে। সুযোগ আসার সঙ্গে সঙ্গে
আবার নাটাইটা টান দেবে। সোজা কথা- হেফাজতের
কমিটি ভেঙে দিয়ে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা তাদের চরিত্র পরিবর্তনের সামান্যতম উদাহরণও
হতে পারে না। অন্তত বাবুনগরী তাঁর সংক্ষিপ্ত ভিডিও ভাষণে যা বলেছেন, তা বিশ্লেষণ করলে
বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, কমিটি ভেঙে দেওয়ার পর দ্রুত যেসব পদক্ষেপ তিনি
নিয়েছেন সেগুলোও প্রমাণ করে হেফাজতে ইসলামি ডোর ছেড়েছে মাত্র। কমিটি ভেঙে দিয়ে আহ্বায়ক
কমিটি গঠনকে বিষধর সাপের ছলং ধরার (চামড়া পাল্টানো ) সঙ্গে তুলনা করা যায়।
তবে হ্যাঁ, হেফাজত তাণ্ডবে তাদের আত্মবিশ্লেষণের
একটা পথ অবশ্যই করে দিয়েছে। তারা যদি মনে করে
যে বাংলাদেশে প্রকাশ্য সংগঠন হিসেবে টিকে থাকবে তাহলে তাদের পথ বেছে নেওয়ার সুযোগও
তৈরি হয়েছে। এতে তাদের ত্যাগও স্বীকার করতে হবে। সেটা অবশ্য শাস্তি ভোগের মাধ্যমে।
দলটি যদি মনে করে তাদের ঘোষণা অনুযায়ী অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে তারা টিকে থাকবে, সেই
সুযোগটি গ্রহণ করতে পারে। হয়তো বা কিছুটা সহানুভূতি তৈরিও হতে পারে। ঘটনাপ্রবাহ দেখে
অনুমান করা যায়, তারা মনে হয় সেই বিষয়টি ভাবতে শুরু করেছে। যেমন দলটিকে অরাজনৈতিক সংগঠন
হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী মনে হতে পারে তাদের আহ্বায়ক কমিটিতে
রাজনৈতিক নেতাদের আর স্থান নাও দেওয়া হতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রথমেই যে নামটি আসে তিনি
হলেন মামুনুল হক। হুট করে ঝলসে ওঠে নানা কাণ্ড ঘটিয়ে তিনি নিজের ও হেফাজতের ইমেজ ধূলিতে
মিশিয়ে দিয়েছেন। এই মুহূর্তে হেফাজত নেতারা কমিটি বাতিল করে দিয়ে তাকে দূরে সরানোর
কাজটি হয়তো করতেও পারেন। কিন্তু খেলাফত মজলিসের অন্য নেতাদের কৌশলে দলে রেখে যদি তারা
এগিয়ে যেতে চান তাহলে তাদের সুবিধা হবে বলে মনে হয় না।
খেলাফত মজলিস নেতাদের ছাড়াও বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জমিয়তে উলামায়ে
ইসলামের ৩৪ জন নেতা আছেন হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে। এছাড়াও নেজামে ইসলামি ও ইসলামি
ঐক্যজোটের একটি অংশও তাদের নেতৃত্বের অংশ। সুতরাং কম্বলের লোম বাছার মতো অবস্থায় পড়তে
হবে তাদের। কারণ, হেফাজতে ইসলামির নেতাদের অধিকাংশই কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের সদস্য।
তাই যারা মনে করছেন, কমিটি বিলুপ্ত করে অরাজনৈতিক রূপ দেওয়া হতে পারে। এই অনুমানটা
কতটা সহজ হবে তাদের জন্য। সেক্ষেত্রে আল্লামা শফীর অনুসারী মাওলানা মঈনুদ্দীন রুহী
যে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, তা নিয়েও সন্দেহমুক্ত হওয়া যায় না। তিনি হেফাজতকে রাজনীতিকরণের
বিরোধিতা করেন এবং আশাবাদ ব্যক্ত করেন, হেফাজত আবার ঐক্যবদ্ধ হয়ে পথ চলতে শুরু করবে।
মাওলানা মঈনুদ্দীন রুহি প্রচণ্ড ধাক্কা খাওয়ার পরও যে স্বপ্ন দেখছেন তা কি জুনায়েদ
বাবুনগরী আহ্বায়ক কিংবা আমির পদে থেকে বাস্তবায়ন করতে পারবেন? ব্রাহ্মণবাড়িয়া ঘটনার
প্রাক্কালে তিনি ‘রক্তের বদলা’ নেওয়ার আহ্বান
জানিয়ে নিজের মারদাঙ্গা রূপ প্রকাশ করেছেন। আর তিনি যে সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে রাজনৈতিক
দলগুলোকে ব্যবহার করেছেন, তাও কি বোঝার বাকি আছে? ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরের নেতৃত্ব
দিয়েছিলেন মূলত এই বাবুনগরী। তিনি তখনও রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা পূরণেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন,
অনেকটা আল্লামা শফীকে পাশ কাটিয়ে। সুতরাং তিনি কোনও রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে না থাকলেও
তার মূল শক্তি যে রাজনৈতিক দলগুলোই ছিল তা অস্বীকার করতে পারবেন? সুতরাং মাওলানা রুহী
কিংবা তাঁর পথের নেতৃবৃন্দ যদি মনে করেন, বাবুনগরীর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফরম গঠিত
হবে তা অবাস্তবই মনে হয়। কারণ, বাবুনগরী এই পর্যন্ত যত কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন, তার
সবই ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত। প্রতিটি কর্মসূচিই পরিচালিত হয়েছে হেফাজতের নেতৃত্বে
থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে এবং সোজা কথায় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে।
তাই এমনটা বলা যায়, হেফাজতে ইসলামি আহ্বায়ক কমিটিতে যদি আল্লামা শফীর অনুসারী দুয়েকজনকে
অন্তর্ভুক্ত করেও তারপরও তাদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা দূর হবে না। হয়তো মামুনুল নিজের
বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে আপাতত দূরে থাকতে বাধ্য হবেন। কিংবা আর দুয়েকজন নেতা হয়তো
তাণ্ডব পরিচালনার অপরাধে সাংগঠনিকভাবে যুক্ত থাকতে পারবেন না। কিন্তু তাদের দূরে সরানোর
আন্তরিকতা হেফাজতের থাকবে না। সেক্ষেত্রে আল্লামা শফীর অনুসারীরা যদি কোনও কারণে আহ্বায়ক
কমিটিতে ঢুকতেও পারে, তাদের কার্যক্ষমতা তেমন থাকবে বলে মনে হয় না।
পূর্বে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী সরকারের
সঙ্গে সমঝোতা চেষ্টায় হেফাজতকে কমিটি ভেঙে দিয়ে অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে হেফাজত পরিচালনার
কথা বলা হয়েছে। মনে হতে পারে, কমিটি ভেঙে দিয়ে প্রথম শর্ত পূরণ করেছে হেফাজত। কিন্তু
রাজনৈতিক নেতাদের দূরে সরালে হেফাজতের শক্তি নিয়ে শঙ্কা তৈরি হতেই পারে। সেক্ষেত্রে
তাদের সামনে দুটি পথ খোলা থাকবে- প্রথমত নিজেদের দুর্বলতাকে মেনে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া,
দ্বিতীয় পথটি হচ্ছে কমিটি বিলুপ্ত করে দিয়ে সরকারকে নমনীয় হওয়ার আহ্বান জানানো। তারা
সম্মেলন করার কথা দুয়েক মাস পর। সেই সম্মেলনের আগে তারা জেলা পর্যায়ে সংগঠিত হওয়ার
চেষ্টা করবে। কিন্তু তারা কি এক্ষেত্রে রাজনীতির বাইরে যেতে পারবে? সন্দেহটা জোরালোই
থেকে যাবে। প্রথম শর্ত পূরণ করে যদি তারা মনে করে গ্রেফতার হওয়া নেতাদের ব্যাপারে সরকার
নমনীয় হবে, সেটাও কতটা বাস্তবভিত্তিক হবে বলা যায় না। কারণ, হেফাজত কাণ্ড যেভাবে গোটা
দেশকে নাড়া দিয়েছে, অন্তত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যে অশনি সংকেত দিয়েছে, সরকার
কি সেসব নেতার ব্যাপারে নমনীয় হতে পারবে?
শাপলাচত্বর ঘটনার পর নেতাদের বিরুদ্ধে
মামলা দায়ের হলেও তাদের কিন্তু গ্রেফতার করা হয়নি। মামলাগুলোও ফাইলবন্দি হয়ে পড়েছিল।
এবার সরকার আইনি ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছে। তাণ্ডবে যখন স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও
বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রতীকে আঘাত হানা হয়েছে, সেক্ষেত্রে আগের মতো নীরবতা পালন সরকারের
পক্ষে সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
এই মুহূর্তে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে বোঝা
যায়, সরকার পিছিয়ে যেতে পারবে না। আর হেফাজত যত চেষ্টাই করুক না কেন, তারা রাজনীতিকে
বাদ দিতে পারবে না। আর যদি মিলেমিশে নতুন হেফাজত গঠনের চেষ্টাও করে সেখানে বাবুনগরীর
নেতৃত্ব দোলায়মানই হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সেক্ষেত্রে হেফাজত যদি ব্র্যাকেটবন্দি হয় তাতেও
অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ
বিষয়ক গবেষক।