ইশরাকের মেয়র পদ নিয়ে এত বিতর্ক কেন, শপথ নিলে কতদিন থাকতে পারবেন?
ঢাকা দক্ষিণ সিটি
কর্পোরেশনের নতুন মেয়র হিসেবে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের নাম ঘোষণা করে গেজেট
প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। মেয়র ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশের আগে এই বিষয়ে
আইন মন্ত্রণালয়ের পরামর্শও চেয়েছিল ইসি। কিন্তু আইন মন্ত্রণালয় তাদের মতামত দেওয়ার
আগেই অনেকটা তাড়াহুড়ো করে রোববার রাতেই গেজেট প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন। খবর
বিবিসি বাংলা।
আইন মন্ত্রণালয়ের
মতামতের অপেক্ষা না করেই গেজেট প্রকাশ করার পরদিন এ নিয়ে কথা বলেছেন আইন উপদেষ্টা
অধ্যাপক আসিফ নজরুল।
সোমবার তিনি
সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের মতামত চাইলেও, মতামত দেওয়ার অপেক্ষা না করেই গেজেট
নোটিফিকেশন করেছেন, আমাদের জন্য অপেক্ষা করে নাই। এখানে আমাদের বলার কিছু নাই।
কেন মতামত চাওয়ার পরও
আইন মন্ত্রণালয়ের অপেক্ষা না করেই গেজেট প্রকাশ করেছে ইসি, এখন সেই প্রশ্নই সামনে
এসেছে।
তবে এ প্রশ্নের জবাবে
নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেন, আদালত থেকে আমাদের কাছে নির্দেশনা
ছিল, আমরা সেই নির্দেশনা মেনে গেজেট প্রকাশ করেছি।
মতামত চাওয়ার পর অপেক্ষা
না করেই গেজেট প্রকাশ করার বিষয়টি কোনো চাপের কারণে হয়েছে কী-না সেই প্রশ্নও
তুলছেন বিশ্লেষকরা।
যদিও অন্তর্বর্তী সরকার
ক্ষমতা গ্রহণের পরপর গত বছরের আগস্ট মাসে মেয়র, কাউন্সিলর, চেয়ারম্যানদের অপসারণ
করে প্রশাসক নিয়োগ করেছিল সরকার। কিন্তু নির্বাচনের হিসাব অনুযায়ী আগামী ১৫ মে
শেষ হচ্ছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদের মেয়াদ। সে হিসেবে শপথ নিয়ে
দায়িত্ব শুরু করলেও এখন কতদিন মেয়র হিসেবে পদে থাকতে পারবেন ইশরাক হোসেন সেই
প্রশ্নও সামনে আসছে।
এর আগে একইভাবে
চট্টগ্রামে বিএনপির প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন চৌধুরীকে মেয়র ঘোষণা করা হয়েছিল।
তিনি এখন চট্টগ্রামের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
গত বছরের পহেলা অক্টোবর
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে শাহাদাত হোসেনকে জয়ী ঘোষণা করে আদালতের রায়ের পর গেজেট
সংশোধিত গেজেট প্রকাশ করেছিল নির্বাচন কমিশন।
গত বছরের পাঁচ আগস্ট
শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর ঢাকার দুই সিটিসহ দেশের ১২টি সিটি কর্পোরেশনের মেয়রদের
অপসারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
চলতি বছরের ২৭ মার্চ
ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. নুরুল ইসলাম
২০২০ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ঢাকা দক্ষিণ সিটি নির্বাচনের ফল বাতিল করে
বিএনপি দলীয় মেয়র প্রার্থী ইশরাক হোসেনকে বিজয়ী ঘোষণা করে রায় দেন।
একই সঙ্গে ওই নির্বাচনে
আওয়ামী লীগের প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপসকে মেয়র হিসেবে অবৈধ ঘোষণা করে সরকারের
গেজেট বাতিল করেন আদালত।
এরপর ইশরাক হোসেনকে ঢাকা
দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশের বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের
পরামর্শ চেয়ে গত ২২ এপ্রিল চিঠি দেয় ইসি। কিন্তু আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত আসার আগেই
রোববার রাতে গেজেট প্রকাশ করে ইসি।
সোমবার রাজধানী ঢাকায়
এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকরা এ নিয়ে প্রশ্ন করে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলের
কাছে।
উপদেষ্টা আসিফ নজরুল
বলেন, এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন আমাদের কাছে জানতে চেয়েছিল। নির্বাচন কমিশন তো
একটা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। আমাদের মতামত জানার আসলে প্রয়োজন ছিল না। ওনাদের
সিদ্ধান্ত ওনাদেরই নেওয়ার কথা।
তিনি আরও বলেন, আমাদের
কাছে যখন মতামতের জন্য পাঠিয়েছিলেন, তখন আমরা সংশ্লিষ্ট আইন কর্মকর্তাদের সঙ্গে
কথা বলেছিলাম। কথা বলে আমরা যেটা জেনেছিলাম যে, নির্বাচনি যে প্লেইন্ড (মামলার
প্রাথমিক আবেদন) আছে সেটা নাকি পরিবর্তন করা যায় না। কারণ হাইকোর্টের রায় আছে এটা
নাকি কোয়াসি সিভিল ম্যাটার। কোয়াসি সিভিল ম্যাটারে প্লেইন্ড পরিবর্তন করা যায় না।
আইন উপদেষ্টা বলেন,
ইশরাক সাহেব নাকি প্লেইন্ড পরিবর্তন করেছিলেন। এ জন্য আমরা একটু দ্বিধান্বিত ছিলাম
যে গেজেট নোটিফিকেশন হবে নাকি এটা নিয়ে আপিল করতে হবে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন
আমাদের মতামতের জন্য অপেক্ষা করেন নাই।
এর ফলে বিগত সরকারের
সময়ের নির্বাচনগুলোকে লিগ্যালাইজ করা হয়েছে কী-না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে
আইন উপদেষ্টা বলেন, এই বিষয়ে আমার কিছু বলার নাই। এটা নির্বাচন কমিশনের ব্যাপার।
যারা এভাবে মামলা করে বা প্লেইন্ড পরিবর্তন করে বিজয়ী হতে চাচ্ছেন ওনাদের জিজ্ঞেস
করেন।
ইসির ওপর চাপ ছিল কী?
২০২০ সালে ইশরাক হোসেন
নির্বাচন ও গেজেট বাতিলের দাবিতে নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। শুরুতে তিনি
বিজয়ী ঘোষণার জন্য আবেদন করেননি।
চলতি বছরের ২৭ মার্চ
ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করে আদালত রায় দেওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে একটু
দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ছিল নির্বাচন কমিশনও। যে কারণে গত মঙ্গলবার আইনি বিষয়ে মতামত
জানতে আইন মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ চেয়ে চিঠিও দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন।
আদালত মেয়র হিসেবে রায়
দিলেও গেজেট প্রকাশে কেন দেরি হচ্ছে সেটি জানতে গত বৃহস্পতিবার সিইসির সঙ্গে দেখা
করেন ইশরাক। এরপরই রোববার রাত সাড়ে দশটার দিকে বিএনপি নেতা ইশরাককে বিজয়ী ঘোষণা
করে গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন।
তাহলে কী বিএনপি নেতার
চাপের কারণেই আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত দেওয়ার আগেই গেজেট প্রকাশ করলো ইসি? এমন
প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষকরা।
সাবেক স্থানীয় সরকার
সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, এই নির্বাচন কমিশন তো স্বাধীন সার্বভৌম
প্রতিষ্ঠান। তারা যদি এখনই চাপের মুখে প্রশ্নবোধক সিদ্ধান্তগুলো নিতে থাকেন, তাহলে
ভবিষ্যতের নির্বাচনগুলো করার ব্যাপারে তারা কি করবেন? কেননা তখন এসব নিয়ে বিতর্ক,
সন্দেহ ও অবিশ্বাস সৃষ্টি হবে।
চাপ ছিল কী-না এই
প্রশ্ন করা হয়েছিল নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদের কাছে। জবাবে তিনি
বিবিসি বাংলাকে বলেন, আমাদের ওপর চাপ ছিল নৈতিকতার। গেজেট করার জন্য একটা সময়সীমা
ছিল। আমরা তো আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কমিশন মনে করেছে, তাই আমরা গেজেট প্রকাশ
করেছি।
শপথ নিলে মেয়াদ কতদিন?
২০২০ সালের পহেলা
ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী
লীগের প্রার্থী ফজলে নূর তাপস চার লাখ ২৪ হাজার ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন।
তার বিপরীতে বিএনপির
প্রার্থী ইশরাক হোসেন পেয়েছিলেন দুই লাখ ৩৬ হাজার ভোট। ওই নির্বাচনে অনিয়ম
কারচুপির অভিযোগও ছিল বিস্তর।
ভোটের এক মাসের মাথায়
ওই বছরের ৩ মার্চ নির্বাচনে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে নির্বাচনের ফলাফল বাতিল
চেয়ে মামলা করেন বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন। ২৭ মার্চ নির্বাচনি আপিল ট্রাইব্যুনালের
রায়ের প্রেক্ষিতে গেজেট প্রকাশ করে ইসি।
নির্বাচনি
ট্রাইব্যুনালের রায়ের প্রেক্ষিতে গেজেটে ইসি শেখ ফজলে নূর তাপসের পরিবর্তে ইশরাক
হোসেনকে নির্বাচিত মেয়র ঘোষণা করে সংশোধিত গেজেট প্রকাশ করা হয়।
শেখ হাসিনা সরকার পতনের
পর গত ১৯ আগস্ট ঢাকার দুই সিটিসহ সারা দেশের ১২টি সিটি কর্পোরেশনের মেয়রদের
অপসারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। সেই হিসেবে ঢাকা দক্ষিণ
সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদ বর্তমানে শূন্য রয়েছে। যে পদে দায়িত্ব পালন করছেন একজন
প্রশাসক।
শূন্য পদের বিপরীতে
উপ-নির্বাচন না দিয়ে কাউকে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করে ইসির গেজেটের পর প্রশ্ন উঠেছে
এই পদে ইশরাক হোসেন কতদিন দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।
আইন অনুযায়ী, ঢাকা
দক্ষিণ সিটির মেয়র পদের মেয়াদ রয়েছে আগামী ১৫ মে পর্যন্ত। ইসির গেজেটের পর এই পদে
শপথ নিলে তার মেয়াদকাল কতদিন হবে সেটি নিয়েও ধোঁয়াশা রয়েছে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ
ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, বর্তমান আইন
অনুযায়ী এই সিটি কর্পোরেশনের মেয়াদ আছে আর ১৫-১৬ দিন। সেই অনুযায়ী যদি নতুন করে
তফসিল ঘোষণা করা হয়, সেখানে যদি ইশরাক হোসেন প্রার্থী হতে চান তাহলে তাকে এই সময়ের
মধ্যেই পদত্যাগ করে পরবর্তী নির্বাচনে প্রার্থী হতে হবে।
আর যদি এই সময়ের মধ্যে
নতুন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা না করা হয় তখন কি হবে? এমন প্রশ্নে অধ্যাপক আহমেদ
বলেন, বর্তমান আইনে এই বিষয়গুলো নিয়ে স্পষ্ট কিছু বলা নাই। তবে স্থানীয় সরকার
কমিশন নতুন যে সংস্কার প্রস্তাব করেছে সেখানে মেয়াদ শেষে ভোট না হলে প্রশাসক
বসানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
তার মতে, এমন ঘটনা এর
আগে ঘটেনি। যে কারণে এখন শপথ নিলে ইশরাক হোসেন কতদিন পদে থাকতে পারবেন তা নিয়ে
একটা আইনগত জটিলতা রয়েই গেছে।
প্রথম উদাহরণ চট্টগ্রাম
সিটি
এর আগে গত বছরের পহেলা
অক্টোবর বিএনপি নেতা শাহাদাত হোসেনকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসাবে
ঘোষণা করেছে আদালত।
২০২১ সালের ২৭
জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তিন লাখ ৬৯ হাজার ভোট পেয়ে মেয়র
নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের রেজাউল করিম চৌধুরী। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির
প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন ধানের শীষ প্রতীকে পেয়েছিলেন প্রায় সাড়ে ৫২ হাজার ভোট।
পরে ভোটে কারচুপির
অভিযোগ তুলে ফল বাতিল চেয়ে ওই মাসেই নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন বিএনপি
নেতা শাহাদাত হোসেন।
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা
সরকার পতনের পর সেই মামলার রায়ে শাহাদাত হোসেনকে নির্বাচিত ঘোষণা করেন চট্টগ্রামের
নির্বাচনি ট্রাইব্যুনাল। পট পরিবর্তনের পর নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালে কাউকে মেয়র
হিসেবে বিজয়ী ঘোষণার প্রথম নজীর ছিল সেটি।
আদালতের রায় অনুযায়ী
ইসি সচিবালয় গত বছরের ৮ অক্টোবর শাহাদাত হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করে গেজেট সংশোধনের
বিজ্ঞপ্তি জারি করে। পরে গত বছরের তেসরা নভেম্বর তাকে চট্টগ্রাম সিটির মেয়র হিসেবে
শপথ পড়ান তৎকালীন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা হাসান আরিফ।