বকেয়ার চাপে সরকার, গরমে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে দুশ্চিন্তা
আগামী
মার্চে সেচ মৌসুম আর
রমজান মাস শুরু হচ্ছে।
তখন গরমের পাশাপাশি সেচের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বাড়বে। এরইমধ্যে
বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহকারী
প্রতিষ্ঠানগুলোর বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) ও পেট্রোবাংলার কাছে
পাওনা জমে আছে প্রায়
৪৫ হাজার কোটি টাকা। তারমধ্যে
বিদ্যুৎ উত্পাদনকারী কম্পানিগুলোর পাওনা প্রায় ৩৮ হাজার কোটি
টাকা এবং গ্যাস ও
এলএনজি সরবরাহকারী কম্পানিগুলোর পাওনা প্রায় ৭ হাজার কোটি
টাকা।
ইতিমধ্যে
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বকেয়া
পরিশোধে সরকারের ওপর দেশি-বিদেশি
কম্পানিগুলোর চাপ বাড়ছে।
গত ১৯ জানুয়ারি বিদ্যুৎ
সরবরাহ বাবদ বকেয়া বিল
পরিশোধে নতুন করে সময়
বেঁধে দিয়ে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ
উন্নয়ন বোর্ডকে (বিপিডিবি) চিঠি দিয়েছে ভারতীয়
আদানি গ্রুপ। আগামী জুনের মধ্যে বকেয়া পরিশোধের জন্য চিঠিতে বলা
হয়েছে। সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ফারহানা মমতাজের
সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক সভায় বেসরকারি
বিদ্যুৎ উত্পাদনকারীরা আগামী রমজান ও বোরোর সেচের
বিদ্যুৎ পেতে জানুয়ারির মধ্যে
অন্তত বকেয়া পাওনার অর্ধেক পরিশোধ করতে সরকারকে অনুরোধ
করেছে।
জানুয়ারির
মধ্যে মোট বকেয়ার অর্ধেক
তারা না পেলে আসন্ন
গ্রীষ্মে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উত্পাদনের জন্য জ্বালানি আমদানি
বাধাগ্রস্ত হবে বলেও জানিয়েছে
উত্পাদনকারীরা।
এদিকে
গত সোমবার বকেয়া বিদ্যুৎ বিল পরিশোধে সহায়তার
জন্য বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (বিপিডিবি) এক হাজার কোটি
টাকা দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ
বিষয়ে বিপিডিবির চেয়ারম্যান রেজাউল করিম বলেছেন, আমরা
গত সোমবার অর্থ বিভাগ থেকে
এক হাজার কোটি টাকা পেয়েছি।
তবে বেসরকারি বিদ্যুৎ উত্পাদনকারী এবং কয়লা সরবরাহকারীদের
কাছে বিপুল পরিমাণ বকেয়ার কারণে এই পরিমাণ অর্থ
নগণ্য।
বিদ্যুৎ
কেনা বাবদ ৩৮ হাজার
কোটি টাকার বেশি পাওনা জমেছে
বলে জানিয়েছেন বিপিডিবির চেয়ারম্যান। প্রায় ছয় মাসের বিল
বকেয়া বলে জানা গেছে।
এ ছাড়া সম্প্রতি সরকারকে
চিঠি দিয়েছে মার্কিন বহুজাতিক কম্পানি শেভরন, এলএনজি সরবরাহকারী কম্পানি কাতার গ্যাস। তবে জ্বালানি তেল
আমদানিতে কিছুটা স্বস্তিতে রয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)। প্রতিষ্ঠানটির বকেয়া
না জমলেও ডলার সংকটের কারণে
তেল সরবরাহ বিদেশি কম্পানিগুলোকে পেমেন্ট দিতে কিছুটা বিলম্বিত
হচ্ছে।
জানতে
চাইলে বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রোডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ) সভাপতি ডেভিড হাসনাত কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিপিডিবির কাছে আমাদের বকেয়া
পাওনা রয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি
টাকা। দীর্ঘদিন ধরেই আমরা বকেয়া
পরিশোধে তাগাদা দিয়ে আসছি। গত
সপ্তাহে জ্বালানি উপদেষ্টা, জ্বালানি সচিব ও বিপিডিবির
চেয়ারম্যানের সঙ্গে আমাদের মিটিং হয়েছে। সেখানে উপদেষ্টা বলেছেন যত দ্রুত সম্ভব
বকেয়ার টাকা পরিশোধে তারা
চেষ্টা চালাচ্ছেন। এখন আমরা জেনেছি
বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়া কিছুটা পরিশোধের জন্য টাকার ব্যবস্থা
করেছে সরকার। আমরা যদি চলতি
মাসে অন্তত তিন হাজার কোটি
টাকা পায়, তাহলে দুই
মাসের তেল আমদানি করতে
পারবো। আমরা যদি বিদ্যুৎকেন্দ্রের
জন্য তেল আনতে না
পারি তাহলে মার্চে সেচ ও রমজান
মাসে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ দিতে পারবো না।
এতে দেশে চাহিদা ও
সরবরাহে বড় ধরনের ঘাটতি
তৈরি হতে পারে।’
ডেভিড
হাসনাত আর বলেন, ‘আমাদেরকে
সিঙ্গাপুর থেকে তেল আমদানি
করতে হয়। এতে এলসি
খোলা থেকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে
তেল পৌঁছানোর জন্য প্রায় ৪৫
দিন সময় প্রয়োজন হয়।
মার্চ থেকে পূর্ণ সক্ষমতায়
বিদ্যুৎ দিতে হলে যে
তেল প্রয়োজন হবে। সেজন্য এই
মাসের মধ্যে আমাদের এলসি খুলতেই হবে।
এই পরিস্থিতিতে আমরা চলতি মাসে
পিডিবিকে অন্তত তিন হাজার কোটি
টাকা দিতে বলেছি। আজকালের
মধ্যে যদি পাওয়া যায়,
আমরা ফেব্রুয়ারি মাসে এলসি খুলে
তেল আমদানি করতে পারব। এর
চেয়ে দেরি হলে অনেক
বেসকারি প্রতিষ্ঠান সময় মতো বিদ্যুৎ
উত্পাদনে যেতে পারবে না।
ফলে রমজান ও বোরোর মৌসুমে
নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হবে।’
অর্থ
সংকটে কয়লা, ফার্নেস অয়েল ও এলএনজি
আমদানি ব্যাহত হওয়ায় গত বছর গরম
মৌসুমে বিভিন্ন সময় পায়রা, রামপাল,
এস আলমসহ অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উত্পাদন
বন্ধ ছিল। এ কারণে
লোডশেডিং বেড়ে গিয়েছিল।
বিদ্যুৎ
বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, শীতের
সময় দেশে বিদ্যুৎ চাহিদা
কমে গেলেও গ্রীষ্মে চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। ২৭
জানুয়ারি দুপুরে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা
ছিল ১০ হাজার মেগাওয়াট।
গত বছরের গ্রীষ্ম, রমজান ও সেচ মৌসুমে
সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল সাড়ে ১৬
হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি। এবার গ্রীষ্মে বিদ্যুতের
সর্বোচ্চ চাহিদা বেড়ে হতে পারে
১৮ হাজার মেগাওয়াট। ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত জ্বালানির
সরবরাহ করা না গেলে
ব্যাপকভাবে ব্যাহত হতে পারে বিদ্যুৎ
উত্পাদন। এতে সারা দেশে
লোডশেডিং বেড়ে বোরো সেচ
মৌসুম কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
বিপিডিবি
সূত্রে জানা গেছে, জুনের
মধ্যে বকেয়া পরিশোধের জন্য বিপিডিবিকে চিঠি
দিয়েছে আদানি গ্রুপ। এর আগে গত
বছরের ৭ নভেম্বর পর্যন্ত
সময় বেঁধে দিয়ে চিঠি দিয়েছিল
আদানি গ্রুপ। ওই সময় একটি
ইউনিট থেকে উত্পাদনও বন্ধ
করে চাপ দেয় তারা।
গত রবিবার বিপিডিবিকে পাঠানো চিঠিতে আদানি বলেছে, বিপিডিবির কাছে তাদের পাওনা
৮৪ কোটি ৫০ লাখ
মার্কিন ডলার। ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত
সময়ে বিপিডিবিকে সরবরাহ করা বিদ্যুতের বিল
হিসেবে এ বকেয়া জমেছে
বিপিডিবির কাছে। জুনের মধ্যে বিল পরিশোধ করা
না হলে চুক্তি অনুসারে
বিলম্ব ফি হিসেবে পরিশোধ
করতে হবে বিপিডিবির।
বিপিডিবির
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেছেন, বিলে কয়লার দাম
নিয়ে বিরোধ আছে। চুক্তিতে উল্লেখিত
সূত্র অনুসারে কয়লার দাম হিসাব করছে
আদানি। আর কয়লার প্রকৃত
দাম ধরে বিল হিসাব
করছে বিপিডিবি। তাদের হিসাবে আদানির পাওনা ৭০ কোটি ডলারের
মতো। পুরনো বকেয়া জমলেও এখন নিয়মিত বিল
পরিশোধ করা হচ্ছে।
বকেয়া পরিশোধের বিষয়ে জানতে বিপিডিবির সদস্য (অর্থ) (যুগ্মসচিব) অঞ্জনা খান মজলিশ এর
সঙ্গে কালের কণ্ঠ থেকে যোগাযোগ
করা হলে তিনি এই
বিষয়ে কথা বলতে রাজি
নয়।
বিপিডিবির
চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম
গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘আদানির বকেয়া পাওনা পরিশোধে বিদ্যুৎ বিভাগ ও অর্থ বিভাগের
সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক হচ্ছে। আমরা
মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
এদিকে
দ্রুত সময়ের মধ্যে বকেয়া পরিশোধে চিঠি দিয়েছে মার্কিন
বহুজাতিক কম্পানি শেভরন এবং কাতার এনার্জি।
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের
কাছে গ্যাস বিক্রি বাবদ বিপুল পরিমাণ
পাওনা অর্থ বকেয়া পড়েছে
শেভরনের, যার পরিমাণ ২২০
মিলিয়ন ডলার। টাকার হিসাবে যা ২ হাজার
৬৮৪ কোটি টাকা পাবে।
এ অর্থ পরিশোধের অনুরোধ
জানিয়ে সম্প্রতি জ্বালানি বিভাগে চিঠি দিয়েছে বৈশ্বিক
জ্বালানি খাতের মার্কিন জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে অন্তত
৭৫ মিলিয়ন ডলার দ্রুততার সঙ্গে
পরিশোধ করা প্রয়োজন বলে
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে
কাতারের রাস লাফফান লিকুইফায়েড
ন্যাচারাল গ্যাস কম্পানি লিমিটেডের (কাতার গ্যাস বা কাতার এনার্জি
নামে পরিচিত) কাছ থেকে আরেকটি
চিঠি পায় জ্বালানি বিভাগ।
বাংলাদেশের কাছে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির
আওতায় তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) বিক্রি বাবদ প্রতিষ্ঠানটির পাওনা
১৫০ মিলিয়ন ডলার। এ চিঠিতেও পাওনা
অর্থ দ্রুত পরিশোধের তাগাদা দেয়া হয়েছে। মোট
৩৭০ মিলিয়ন ডলার পাওনা পরিশোধের
অনুরোধসংবলিত চিঠি দুটির অনুলিপি
এরই মধ্যে পেট্রোবাংলার কাছেও পাঠানো হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অর্থ) একেএম মিজানুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা বিষয়টি জ্বালানি
বিভাগে চিঠি দিয়ে জানিয়েছি,
জ্বালানি বিভাগ বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়েছে। আশা
করছি দ্রুত সময়ের মধ্যেই তাদের বকেয়া পরিশোধ করা সম্ভব হবে।
মূলত ডলার রেট বেড়ে
যাওয়ার কারণে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে পর্যাপ্ত ডলার
পাওয়া যাচ্ছে না। এতে নিয়মিত
পেমেন্ট দেওয়া যাচ্ছে না।’
জিটুজি
ভিত্তিতে কাতারের কাছ থেকে দীর্ঘমেয়াদি
চুক্তির আওতায় এলএনজি আমদানি করছে পেট্রোবাংলা। এ
এলএনজির মূল্য বাবদ বকেয়া পড়ে
যাওয়া ১৫০ মিলিয়ন ডলার
দ্রুততার সঙ্গে পরিশোধের অনুরোধ জানিয়েছে কাতার গ্যাস। এর মধ্যে কাতার
গ্যাসের বকেয়া পরিশোধেই এখন সবচেয়ে বেশি
গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বলে
পেট্রোবাংলা সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
তাদের
ভাষ্যমতে, জিটুজি চুক্তির আওতায় নির্দিষ্ট সময়ে বকেয়া পরিশোধে
প্রতিশ্রুতিবদ্ধ পেট্রোবাংলা। সেটি করা না
হলে সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় বড় ঝুঁকি তৈরি
হওয়ার জোর আশঙ্কা রয়েছে।
আবার শেভরনের জরুরিভিত্তিতে চাওয়া ৭৫ মিলিয়ন ডলারও
পরিশোধ করে দিতে চায়
জ্বালানি বিভাগ। শেভরন বাংলাদেশের তিনটি গ্যাসক্ষেত্র জালালাবাদ, মৌলভীবাজার ও বিবিয়ানা থেকে
গ্যাস উত্তোলন করে সরবররাহ করছে।
যা মোট দেশীয় প্রাকৃতিক
গ্যাস উত্পাদনের প্রায় ৬০ শতাংশ এবং
দেশীয় কনডেনসেট উত্পাদনের ৮৩ শতাংশের মতো।
প্রতিষ্ঠানটির গ্যাস ও কনডেনসেট বিক্রির
বিপুল পরিমাণ বকেয়া জমে পেট্রোবাংলার কাছে।
উপস্থাপক
ইয়াশার সঙ্গে কী ঘটেছিল?
পেট্রোবাংলা
সূত্রে জানা গেছে, পেট্রোবাংলাকে
গ্যাস সরবরাহ বাবদ শেভরনের কাছ
থেকে প্রতি মাসে বিল আসে
৪০ মিলিয়ন ডলারের মতো। কয়েক মাস
ধরেই শেভরনের বিল বকেয়া জমেছে।
গত ডিসেম্বরে শেভরন ইন্টারন্যাশনাল এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্ক
ক্যাসুলো বাংলাদেশ সফর করে প্রধান
উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের
সঙ্গে সাক্ষাৎ করে যান। ওই
বৈঠকে বকেয়া বিল নিয়েও আলোচনা
হয়।
দেশে
গ্যাসের সরবরাহ ঘাটতি পূরণে ২০১৮ সালের এপ্রিল
থেকে কাতার গ্যাসের কাছ থেকে কার্গোয়
করে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। প্রতি
বছর গড়ে কম-বেশি
৪০ কার্গো এলএনজি সরবরাহ করছে কম্পানিটি। চলতি
অর্থবছরও কাতার থেকে মোট ৪০
কার্গো এলএনজি আমদানির কথা রয়েছে। এর
অর্ধেক এরই মধ্যে দেশে
এসেছে।