মধ্যবিত্ত: অর্থবিত্তে এগিয়ে পিছিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায়
বহুদিন পর, বহুদিন পর শিশির ভেজা ঘাসের
ওপর পা রাখি গত সপ্তাহে। উপলক্ষ ছিল বেড়ানো। ঢাকার অনতিদূরে, আমাদের দেশের বাড়ির পথে।
ঢাকা থেকে উত্তরা, টঙ্গী, জয়দেবপুর, রাজেন্দ্রপুর, তার পরেই কাপাসিয়ার রাস্তা; যা দিয়ে
কিশোরগঞ্জ যাওয়া যায়। সেখানে রাজাবাজার বলে একটি জায়গা আছে; যা সম্ভবত ভাওয়ালের রাজার
নামে। এর কাছেই একটি রিসোর্ট। বিজয় দিবস উপলক্ষে ভিড় হবে জেনে এর আগেই বেড়ানোর দিন
ধার্য করা হয়। এসব করে আমার মেয়ে সুবর্ণা ও জামাতা সৌমিত্র। সঙ্গে নাতনি অদ্বিতীয়া।
আমরা স্বামী-স্ত্রী ও বেয়াইন তাদের সঙ্গী। গ্রামাঞ্চলে, ধরা যায় বনাঞ্চলের রিসোর্টে
দিন কাটানোর লোভ কার না হয়! আমিও তাই রাজি হয়ে গেলাম গাজীপুরের বনাঞ্চলে। ফল? ফল শিশির
ভেজা ঘাসের ওপর পা রাখার প্রৌঢ় বয়সের অনুভূতি। ছোটবেলায় এসব ছিল নিত্য ঘটনা। ঢাকাবাসী
হওয়ার পর থেকে শিশির ভেজা ঘাস কোথায় পাব? কোথায় পাব ভোরের লাল সূর্য, সন্ধ্যাবেলায়
ডুবন্ত লাল সূর্য? বহুদিন আগেই তো প্রকৃতির সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেছি। গ্রামের বাড়ি
বেদখল। তাই পুকুরে স্নান-গোসল করা কীভাবে হবে, কীভাবে হবে নদীতে সাঁতার কাটা। বহুদিন
দেখা হয় না বিচিত্র রকমের গাছ-বৃক্ষ। দেখি না গাছে গাছে ঝুলন্ত ফল—কাঁচা-পাকা। ভোরবেলার
পাখির কলতান ঢাকায় কোথায় পাব? থাকি প্রায় অন্ধকার ফ্ল্যাটে। রোদের সঙ্গে, সূর্যের সঙ্গে
কোনো সম্পর্ক নেই। পুকুরের জলে একটু পা রাখব তার ব্যবস্থা কোথায়? পুরান ঢাকায় যখন থাকতাম
তখন মাঝে মাঝে যেতাম বুড়িগঙ্গার পাড়ে। পাড়ের রাস্তা দোকান আর যানবাহনে ভর্তি। নদীর
জল কালো—পেট্রল, গ্রিজে
ভারী। এতে হাত দেয়ার ব্যবস্থা নেই, স্নান-গোসল তো দূরের কথা। এক কথায় প্রকৃতি, প্রাকৃতিক
সৌন্দর্য থেকে দূরে, বহুদূরে। বলা বাহুল্য, এমন একটা মানুষ বহুদিন পর একটি রিসোর্টে
গিয়ে প্রকৃতির সান্নিধ্য পেলাম। কয়েকশ বিঘা নিয়ে রিসোর্টটি। গাছপালায় ভর্তি, ফলমূলে
ভর্তি। কৃত্রিম লেক আছে। খেলাধুলার ব্যবস্থা আছে। কত বিচিত্র ধরনের ফল, কত বিচিত্র
ধরনের ফুল। কিছুু ফল ও ফুলের নাম জানি, কিছু গাছের নাম জানি, বাকিগুলোর জানি না—মনে নেই। আফসোস
হয়, আজ রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ওয়াহিদুল হক ভাই নেই; নেই প্রকৃতিপ্রেমী দ্বিজেন শর্মা।
তাদের সঙ্গে কোথাও গেলে আর গাছ দেখলে অথবা দেখলে ফুল—প্রথম প্রশ্ন,
বলো তো এর নাম কী? অবলীলাক্রমে নাম ও গুণাগুণ বলে দিতেন। আর খবরদার কোনো ফুল গাছ থেকে
ছিঁড়বে না। ফুলেরা গাছেই সুন্দর, যেমন ‘শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’। বলতেন, সুযোগ
পেলেই গাছের পাতায় হাত লাগাবি, জলের সন্ধান পেলে জলে পা লাগাবি। গাছ-বৃক্ষের পাতায়
ঝুলে আছে তোমার-আমার জীবন। গাছ অক্সিজেন দেয় আমাদের। জল হচ্ছে প্রাণের উৎস। সূর্য মহাপ্রভু—সকল প্রাণের উৎস।
এই হচ্ছে প্রকৃতি। তারা দুজনই বলতেন শহরে আছ, থাকো। তবে চেষ্টা করবে প্রকৃতির সঙ্গে
যোগাযোগ রাখতে। বাড়িতে এয়ারকন্ডিশন, গাড়িতে এয়ারকন্ডিশন, অফিসে এয়ারকন্ডিশন, স্কুল-কলেজে
এয়ারকন্ডিশন—এতে সূর্যের সঙ্গে
দেখা কোথায়? বলতেন, তোমাদের ছেলে-মেয়েদের, নাতি-নাতনিদের এভাবে মানুষ করো না। রিসোর্টের
পথে পথে হাঁটি, তাদের কথামতো ফুল ধরি, ছিঁড়ি না; গাছের পাতায় হাত লাগাই, কৃত্রিম হ্রদের
জলে পা লাগাই। আনন্দই আনন্দ। সঙ্গে আমার নাতনি অদ্বিতীয়া। ও তো পাগল এসব আয়োজন দেখে।
বাস করে বদ্ধ ঘরে, বদ্ধ জীবন। স্কুলে আছে একটা বিল্ডিং, আর কিছু নেই। তাই তার আনন্দের
সীমা নেই। আর আমার হচ্ছে অনুভূতি। মনে পড়ে ছোটবেলার স্মৃতি। প্রাইমারি স্কুল, হাই স্কুল,
কলেজ, তারপর বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। পরীক্ষা পাস, ডিগ্রি, চাকরি। বৈবাহিক জীবন। ধীরে ধীরে
কবে যে গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছি তা টের পাইনি। বিচ্ছিন্ন হয়েছি প্রকৃতির সঙ্গে।
প্রকৃতি, গ্রাম, লতাপাতা, নদী-নালা, গ্রামবাসী, সহপাঠীদের কথা মনে পড়ল চাকরি থেকে অবসরে
যাওয়ার পর। ধীরে ধীরে স্মৃতিই সম্বল হতে শুরু হলো। চীন থেকে আসা কভিড-১৯ আবার তীব্রভাবে
স্মরণ করিয়ে দিল প্রকৃতির কথা। ঘরবন্দি জীবন। চারদিকে মৃত্যুসংবাদ, দুঃসংবাদ। শুয়ে-বসে
ভাবি সেই ছোটবেলার কথা, মধুর স্মৃতি।
ঘরে শুয়ে বসে যখন ক্লান্ত, দিশাহীন তখন
একসময় বোঝা গেল করোনার প্রকোপ কিছুটা কমেছে। এ সুযোগেই রিসোর্টে বেড়াতে যাওয়া। রিসোর্ট
মানে কী? প্রায় ‘জঙ্গলের’ জীবন। মাত্র
দুই রাত। অফুরন্ত গাছপালার মধ্যে কিছু ছোট দালান, কুঁড়েঘর ইত্যাদি। আমাদের মতো অনেক
অনেক ভ্রমণপিপাসু সেখানে। কত ‘জাতের’ মানুষ, ছোট ছোট ফুলের মতো শিশু।
মনে হচ্ছিল সবাই পাগলের মতো এখানে এসেছে প্রকৃতির ছোঁয়া নিতে। প্রকৃতি কিন্তু খাওয়া-দাওয়া
ইংরেজি স্টাইলের। দুইয়ের নিমন্ত্রণ। দুই স্বাদ একসঙ্গে। এ উদ্যোগে আমরা একা নই। কাগজে
দেখলাম কক্সবাজারে গিয়ে হাজির তিন-চার লাখ ভ্রমণপিপাসু। মহান বিজয় দিবসের ছুটি একদিন,
সঙ্গে শুক্র-শনি। তিনদিনের ছুটিতে মানুষ পাগলের মতো বেরিয়ে পড়েছে। দুই বছর কভিড-১৯
মহামারীর জন্য কেউ বেড়াতে যেতে পারেনি। বন্ধ ছিল নাগরিক জীবন। নানা বিধি-নিষেধ। অর্থ-কড়ির
সংকট। এখন একটু স্বস্তি ফিরে আসতেই আসন্ন ‘ওমিক্রনের’ ঝুঁকি নিয়েই
মানুষ বেরিয়ে পড়েছে প্রকৃতির সন্ধানে। এরা কারা? কারা আজকের দিনে শহর থেকে ছুটে যায়
পাহাড়ে, সমুদ্রপাড়ে, গ্রামে অথবা দূরদেশে? এরা কি সাধারণ মানুষ, সাধারণ চাকরিজীবী?
কারা এখন রিসোর্টে, হোটেলে, মোটেলে যায় বেড়াতে; যায় হোটেলে-রেস্টুরেন্টে? ফুলের দোকানে,
মিষ্টির দোকানে, শপিংমলে, ব্র্যান্ড বিপণিতে কারা যায়? এরা কি মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত,
ধনীশ্রেষ্ঠ?
এর সঠিক উত্তর পেতে দরকার মাঠ পর্যায়ের
জরিপ। এ জরিপ আমাদের দেশে নেই। মধ্যবিত্তের বিকাশের ওপর কোনো গবেষণা নেই কোনো গবেষকের।
তবে দৃশ্যমান ঘটনা থেকে কিছুটা আন্দাজ করা যায়। মনেই হয় অতি বিত্তশালী যারা তারা দেশে
বেড়ায় না। তারা যায় অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশ, কানাডা
ও আমেরিকায়। অনেকের সেখানে বাড়িঘর আছে, ঘরসংসার আছে, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আছে। অনেকের
পরিবারও সে দেশে। বছরের বেশ কিছুটা সময় তারা কাটান বিদেশে পরিবারের সঙ্গে। আজকাল প্রযুক্তির
বদৌলতে তারা বাংলাদেশের ব্যবসা পরিচালনা করেন বিদেশ থেকে। আরেক নিরাপদ গন্তব্য স্থান
হচ্ছে আবুধাবি ও দুবাই। বহু বাংলাদেশীর বসবাস সেখানে। এসব কারণে বলা যায়, অতিধনী, এমনকি
ধনীরাও দেশের সমুদ্রসৈকতে কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রামে অথবা সিলেটে বা খুলনায় যায় কম,
খুবই কম। বাংলাদেশের আবহাওয়া তাদের পছন্দ হয় না। দূষিত আবহাওয়া, দূষিত খাবার জল, ট্রাফিক
জট, সুস্থ পরিবেশবিহীন খাবার-দাবার। এ অবস্থায় মনে হয় ইদানীং যারা ছেলে-মেয়েদের নিয়ে
দেশের ভেতর বেড়াতে বেরোয়, তারা উঠতি মধ্যবিত্ত। চাকরিজীবী, পেশাজীবী, স্বনিয়োজিত ব্যক্তি,
উকিল, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আর্কিটেক্ট, ব্যাংকার, বীমাবিদ ইত্যাদি শ্রেণীর লোকেরা
বেড়ায়। ছেলে-মেয়েরা প্রেরণার একটা উৎস। স্কুলে পড়ুয়া, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের
স্কুল-কলেজে খেলার মাঠ নেই; ঘরোয়াভাবে খেলার কোনো ব্যবস্থা নেই; বিনোদনের ব্যবস্থা
নেই; বুকভরে শ্বাস নেয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। সাঁতার শেখা, সাইকেল চালানো, দাড়িয়াবান্ধা,
গোল্লাছুট ইত্যাদি খেলার কোনো ব্যবস্থা নেই। এদের কাছে সূর্যোদয়ও নেই, সূর্যাস্তও নেই।
যন্ত্রের মতো বিষয়। এসব ছেলেমেয়ে মা-বাবাকে পাগল করে বেড়ানোর জন্য। অভিভাবকরা ছুটে
যান সৈকতে, পাহাড়ে-পর্বতে। এরা উদীয়মান মধ্যবিত্ত, এমনকি নিম্নবিত্ত। বিকাশমান মধ্যবিত্ত।
এখনো সে পরিণত মধ্যবিত্তে পরিণত হয়নি। মধ্যবিত্তের কতগুলো মৌলিক মূল্যবোধ থাকে, যা
গণতান্ত্রিক দেশে বিরাজমান। আমাদের শহরে মধ্যবিত্ত না শহুরে, না গ্রামের। মাঝে মাঝে
মনে হয় ঢাকার মধ্যবিত্ত যেন গ্রামের বাসিন্দা। তবু সই। আস্তে আস্তে পরিণত মধ্যবিত্তের
দিকে তারা ছুটে চলেছে। পয়সা হয়েছে। এখন দরকার ভদ্র-সুস্থ সাংস্কৃতিক-প্রাকৃতিক জীবন,
যারা প্রকৃতিকে ভালোবাসবে, ফুল ভালোবাসবে, গাছপালা, পাহাড়-পর্বত ভালোবাসবে, গণতান্ত্রিক
মূল্যবোধ লালন করবে। যারা ধর্মীয় গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে উঠে কসমোপলিটান জীবনে অভ্যস্ত হয়ে
উঠবে। শত হোক টাকা-পয়সা কমফোর্ট দিতে পারে, আরাম-আয়েশ দিতে পারে, সুযোগ-সুবিধা দিতে
পারে কিন্তু এর দ্বারা সংস্কৃতিমনা জাতি হওয়া যায় না। উন্নত, বুদ্ধিমান, অগ্রসর চিন্তার
বিজ্ঞানমনস্ক জাতি হওয়া যায় না। এর জন্য সময় লাগে। এক-দুই প্রজন্ম লেগে যায়। অর্থনৈতিক
অগ্রগতির পাশাপাশি তা অর্জনের সংগ্রামও চালিয়ে যেতে হয়।
শুভ সংবাদ, আশাজাগানিয়া সংবাদ, এখন মধ্যবিত্ত,
বিত্তশালী ও নিম্নমধ্যবিত্তরা ফুলকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। কিছুদিন আগেও ঢাকা শহরে
ফুলের দোকান ছিল নগণ্যসংখ্যক। ফুল মানে কী? সৌন্দর্যের প্রতীক, আলোকিত সভ্যতা ও জীবনের
প্রতীক। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ফুল এখন শুধু মেয়েদের খোঁপার সজ্জা নয়, ফুলের কদর সর্বত্র।
ঢাকা শহরের অলিগলিতে এখন ফুলের দোকান। বিয়েশাদি. জন্মদিন, সামাজিক অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক
অনুষ্ঠান, একুশে ফেব্রুয়ারিতে ফুল ব্যবহার এখন সাধারণ একটা ঘটনা। বিদেহী আত্মাকে স্মরণ
করতেও এখন ফুলের কদর। ফুলের কদরের ফল কী? ফল হচ্ছে সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় ফুল এখন
বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ, চাষী, কৃষক ফুল চাষ করে জীবিকা নির্বাহ
করছেন। দশক দুয়েক আগেও এটা ছিল অকল্পনীয়। ফুলের বাজার বসবে, ফুলের বাণিজ্যিক চাষ হবে,
ফুলের হিসাব জিডিপির হিসাবে ঢোকার যোগ্য হবে—এসব ছিল কল্পনারও অতীত ঘটনা। এই তো সেদিন
ফুলের ওপর একটা স্টোরি পড়লাম একটি দৈনিকে, মানে দৈনিক বণিক বার্তায়। খবরটির শিরোনাম—করোনা পরবর্তী
ফুলের বাজার, দুই দিবসে গদখালীতে দেড় কোটি টাকার ফুল বিক্রি। গদখালী মানে যশোর জেলার
গদখালী, যেখানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুল চাষ শুরু হয় প্রায় দেড়-দুই দশক আগে। এখন সেই
গদখালী ফুল চাষের আদর্শ। এখানে উৎপাদন হয় গাঁদা ফুল, গোলাপ ফুল, রজনীগন্ধা, রঙিন গ্লাডিউলাস,
জারবেরা, কামিনীর পাতা, জিপসির আঁটি। সংশ্লিষ্ট স্টোরিটিতে কোন ফুল কী দরে বিক্রি হচ্ছে,
তার একটা হিসাবও দেয়া হয়েছে। করোনার সময় ফুলের চাষীরা লোকসান দিয়েছেন, যারপরনাই কষ্ট
করেছেন। বাজার ছিল না। অনুষ্ঠান ছিল না। এখন করোনা-পরবর্তী সময়ে কিছুটা স্বস্তি ফিরে
আসায় মানুষ আবার পাগলের মতো ফুল কিনছে। সব অনুষ্ঠানে ফুল আর ফুল। বলা হচ্ছে প্রতিটি
ফুলের দাম দ্বিগুণের মতো হয়েছে। চাষীদের মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। সামনে বাঙালির অনেক
অনুষ্ঠান। বিজয় দিবস সবে গেল। আসছে ইংরেজি নববর্ষ ক্রিসমাস, তারপর মহান ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি,
আসছে পহেলা ফাল্গুন, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, তারপর ২৬ মার্চে আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস।
এপ্রিলে আমাদের বাংলা নববর্ষ। সবকিছু ঠিক থাকলে ফুল-পুষ্পচাষীরা তাদের জীবন পুরোদমে
ফিরে পাবেন। আমার ধারণা এবার এসব অনুষ্ঠানে আড়ম্বর অনেক বেশি হবে। শত হোক দুটো বছর
আমরা ঘরবন্দি ছিলাম। এখন একটু একটু করে বেরোচ্ছি। যদিও ভয়ভীতি আছে, নতুন আপদ ওমিক্রন
থেকে। ভয়ানক ছোঁয়াচে ধরন তা। পৃথিবীর বহু দেশে তা ছড়িয়ে পড়েছে। সৌভাগ্যক্রমে আমরা এখনো
এর থেকে মুক্ত। যদি এ প্রবণতা অব্যাহত থাকে তাহলে শুধু ফুলের চাষ ও বিক্রি বৃদ্ধি পাবে
না, ব্যবসা হবে বিনোদনের জগতে। কাগজে পড়লাম কক্সবাজারের কথা। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস
ছিল ছুটি, বৃহস্পতিবার। পরের দুদিন ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে লাখো
মানুষ ছুটে যায় কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকত, পার্বত্য চট্টগ্রামে। গাড়ি, বাস, ব্যক্তিগত
গাড়ি, বিমানে করে মানুষ যায় সমুদ্রসৈকতে, পাহাড়ে। ফল? ফল হচ্ছে চূড়ান্ত ব্যবসা। হোটেল,
মোটেল কিছুই খালি নেই। বাড়ি-ঘরে স্থাপিত ছোট ছোট রেস্ট হাউজে জায়গা নেই। বাড়ির মালিকরা
ঘর ভাড়া দিয়েছেন। তবু জায়গা নেই। মানুষ, মধ্যবিত্ত, এমন বিলাসী শহরবাসী গাড়িতে কাটিয়েছে
রাত, ফুটপাতে কাটিয়েছে রাত। হোটেলে খাবার নেই। নাশতার ব্যবস্থা নেই। দুপুরের খাবার
নেই, পরিবহন নেই, শ্রমিক নেই, রাস্তায় গাড়ি রাখার জায়গা নেই। এ যেন দুই বছরের ব্যবসা
একশ্রেণীর ব্যবসায়ী এক সুযোগেই করে নিচ্ছেন। সরকার জরিমানার ব্যবস্থা করেছে, শাস্তি
দিয়েছে লোভী ব্যবসায়ী ও অন্যদের। কিন্তু কীসে কী? বাঙালির ব্যবসা ছাড়াছাড়ি নেই। যেমন
মধ্যপ্রাচ্যে গমনেচ্ছুদের কাছ থেকে ভাড়া নেয়া হচ্ছে দেড় গুণ, দ্বিগুণ। এটা থামানোর
জন্য মন্ত্রী চেষ্টা করেও ব্যর্থ। এ যেন দুই বছরের ব্যবসার লোকসান অতিদ্রুত তুলে নিতে
হবে। ওষুধের কোম্পানি, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বিক্রেতা, শাকসবজির
বিক্রেতা—কেউ রেহাই দিচ্ছেন
না উদীয়মান মধ্যবিত্তকে। দেশী মুরগি খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। কক মুরগি থাকে বলে তার দামও
হয়েছে দ্বিগুণ। ব্যবসা কাকে বলে! মধ্যবিত্ত বিনোদনে রেহাই পাচ্ছে না, নিত্যপ্রয়োজনীয়
পণ্য ক্রয়ে রেহাই পাচ্ছে না, পরিবহন, খানাপিনা, হোটেল খরচ—এর কোনোটাতেই
রেহাই পাচ্ছে না। সরকার তাদের আয় কমিয়েছে, বাজার তাদের চেপে ধরেছে। তাই নয় কি? তথ্য:
বণিক বার্তা
ড. আর এম দেবনাথ: অর্থনীতি বিশ্লেষক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক
বিঃ দ্রঃ- মত ভিন্ন মত বিভাগের লেখার আইনগত
ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।