ছাড়ের প্রতিযোগিতায় ব্যাংক
ব্যাংক খাতে বর্তমানে উদ্বৃত্ত তারল্যর
পরিমাণ হচ্ছে দুই লাখ পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি। অলস এ অর্থের একটি অংশ সরকার ঋণ
হিসেবে নিয়েছে। কিন্তু সরকারও ঋণ চাহিদা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সম্প্রতি। উদ্বৃত্ত
তারল্যের চাপ কমাতে কয়েকটি ব্যাংক আমানত নিতে নিরুৎসাহিত করছে। মুনাফা ধরে রাখতে অন্য
ব্যাংকের ভালো গ্রাহক টানতে বিশেষ ছাড় দেয়া শুরু করেছে ব্যাংকগুলো। ব্যাংক খাতের
দায়িত্বশীল ও তারল্যের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এমন তথ্য।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী,
গত ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতে মোট তারল্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে চার লাখ ১৪ হাজার
৩৫৭ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী এই সময়ে ব্যাংকগুলোর
হাতে দুই লাখ ৯ হাজার ৬১৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা রাখার প্রয়োজন ছিল। এ হিসাবে ব্যাংক খাতে
উদ্বৃত্ত তারল্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই লাখ চার হাজার ৭৩৮ কোটি টাকার বেশি। ছয়
মাস আগে, অর্থাৎ গত বছরের জুন শেষে এ ব্যাংক খাতে মোট তারল্যর পরিমাণ ছিল তিন লাখ ৩৫
হাজার ৭৯৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। ছয় মাসের ব্যবধানে উদ্বৃত্ত তারল্য জমা হয়েছে ৭৮ হাজার
৫৫৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। সরকারও ঋণ না নেয়ার ঘোষণা দেয়ায় উদ্বৃত্ত তারল্য নিয়ে বিপাকে
পড়েছে ব্যাংকগুলো।
উদ্বৃত্ত তারল্য ও ব্যাংক খাতের বিদ্যমান
ঋণ পরিস্থিতির বিষয়ে বেসরকারি পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল হালিম চৌধুরী
বলেন, ‘ঋণ চাহিদা তো
তেমন নেই। মুষ্টিমেয় ভালো গ্রাহক ঋণ নিচ্ছে। তারাই এখন ঋণ সুদহার নিয়ে দর কষাকষি
করছে। এজন্য আমরা সাড়ে সাত শতাংশ সুদহারে ঋণ দিচ্ছি। অনেকে আরও কমে দিচ্ছে। এজন্য
আমানত সুদহার সারে চার শতাংশেরও নিচে নেমে গেছে। নইলে ব্যাংক তো চলবে না। ঋণ চাহিদা
না বাড়লে এ পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।’
ব্যাংকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে,
করপোরেট গ্রাহকরা এখন সবচেয়ে কম সুদে ঋণ খুঁজছে বিভিন্ন ব্যাংকে। অনেকেই আবার রাষ্ট্রায়ত্ত
ব্যাংকেও ফেরার চেষ্টা করছে। কিছু প্রতিষ্ঠান ঋণের পোর্টফলিওকে দুই ভাগে বিভক্ত করছে।
নতুন ঋণ নিয়ে বেশি সুদের পুরনো ঋণ পরিশোধ করছে।
করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাবের আগে থেকেই
ব্যাংকঋণের চাহিদা কম ছিল উদ্যোক্তাদের। ২০১৯ সালেও বেসরকারি ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি
ছিল নেতিবাচক। সেই প্রবৃদ্ধি আরও নেতিবাচক হয় করোনা মহামারিতে। এই সময়ে ব্যাংকগুলো
তারল্যের কিছুটা সরকারকে ঋণ হিসেবে দেয়। কিন্তু সম্প্রতি সরকারও ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া
কমিয়ে দেবে বলে জানিয়ে দিয়েছে, যার প্রতিফলন ঘটেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশোধিত মুদ্রানীতিতে।
সরকারের ঋণ চাহিদা কমে যাওয়ায় অর্থবছরের (২০২০-২১) অবশিষ্ট ছয় মাসের জন্য মুদ্রানীতিতে
সংশোধন এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গত জুলাইতে দেয়া সরকারি পর্যায়ের বিভিন্ন
ঋণের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে দিয়েছে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সব ধরনের ঋণপ্রবাহ কমিয়ে
দেয়া হয়েছে। গত জুলাইতে ঘোষিত মুদ্রানীতিতে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল
১৯ দশমিক তিন শতাংশ। গত ৩ ফেব্রুয়ারি তা সংশোধন করে ১৭ দশমিক চার শতাংশে নামিয়ে আনা
হয়।
সংশোধিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের
প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ১৪ দশমিক আট শতাংশ একই রাখা হয়। কিন্তু সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধির
লক্ষ্যমাত্রা ৪৪ দশমিক চার শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩১ দশমিক সাত শতাংশ করা হয়।
জানা গেছে, বেসরকারি খাতে চাহিদা কম থাকায়
উদ্বৃত্ত এ তারল্যের একটি অংশ সরকারকে ঋণ হিসেবে দিয়েছে ব্যাংকগুলো। সরকারি বিভিন্ন
সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের মাধ্যমে এ ঋণ দিয়েছে ব্যাংকগুলো। কিন্তু সরকারি পর্যায়ে ঋণপ্রবাহ
কমে যাওয়ায় ব্যাংকের মুনাফা ধরে রাখতে অন্য ব্যাংকের ভালো গ্রাহককে বিভিন্ন ছাড়
ঘোষণা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো।
এর মধ্যে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক সাড়ে সাত
শতাংশে অন্য ব্যাংকের ঋণ কিনে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এজন্য ব্যাংক কর্মকর্তাদের লক্ষ্যমাত্রাও
বেঁধে দিয়েছে। ব্যাংকটির মতিঝিল এলাকায় থাকা শাখাগুলো লিফলেট প্রচার করছে। বিভিন্ন
অফিসে গিয়ে প্রতিনিধিরা গিয়ে ঋণের সুবিধা বর্ণনা দিচ্ছেন।
কোনো গ্রাহক একটি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে থাকলে অন্য আরেকটি ব্যাংক সমুদয় অর্থ পরিশোধ করে ঋণটি নিতে পারে। এটিকে ব্যাংকিং ভাষায় টেকওভার বলে। গত বছরের এপ্রিল থেকে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ নির্ধারণ করেছে সরকার। কিন্তু কিছু ব্যাংক সেই সুবিধা গ্রাহকদের দিয়েছে অনেক পরে। বর্তমানে ৯ শতাংশ সুদহার থাকলেও সাড়ে সাত শতাংশ দিয়ে ঋণগুলো কিনে নিতে চাচ্ছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক।
বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংকের কর্মকর্তারা
বিভিন্ন গ্রাহককে ফোন দিয়ে ঋণ টেকওভারের প্রস্তাব দিচ্ছেন। পাঠাচ্ছেন মোবাইল ফোনে
এসএমএস। এ বিষয়ে রাজধানীর আইটি খতের ব্যবসায়ী নিজামুল হক বলেন, ‘আমার একটি কনজ্যুমার
ঋণ আছে ১০ লাখ টাকার। পাঁচ লাখ পরিশোধ করা হয়েছে। সম্প্রতি কয়েকটি ব্যাংক থেকে প্রস্তাব
এসেছে। বর্তমান ব্যাংকের চেয়েও কম সুদে ঋণটি টেকওভার করবে তারা।’
তারল্যের চাপে বেসরকারি খাতের কয়েকটি
ব্যাংক আমানত সংগ্রহে নিরুৎসাহিত করছে শাখাগুলোকে। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর
একটি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক জানান, ‘গত ডিসেম্বর মাসেও
সাত শতাংশ দিয়ে আমানত নিয়েছি। কিন্তু জানুয়ারিতে কমানো হয়। ফেব্রুয়ারিতে এখন মাত্র
সোয়া চার শতাংশের আমানত পাওয়া যাচ্ছে। তাও নিচ্ছি না। দীর্ঘমেয়াদি বা বড় অঙ্কের
আমানত পেলে নেয়া হচ্ছে। ছোট অঙ্কের বেলায় আরও দর কষাকষি করে নেয়া হয়। ব্যাংকারদেরও
আমানত সংগ্রহে কোনো লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হচ্ছে না।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে ব্যাংক খাতে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা।
সূত্র: শেয়ার বিজ