রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীতে পদোন্নতি ছাড়াই র্যাঙ্ক
পুলিশের মতোই একটি শৃঙ্খলাপরায়ণ বাহিনী রেলওয়ে
নিরাপত্তা বাহিনী (আরএনবি)। সম্পদ বিবেচনায় দেশের রেলওয়ের সারাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে
থাকা সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা এ বাহিনীর মূল দায়িত্ব।
পুলিশের মতো মামলা করা, মামলা তদন্ত, এমনকি আসামি গ্রেপ্তারও করতে পারে এ বাহিনী।
পদমর্যাদার ধরনও অনেকটা কাছাকাছি। পুলিশের যেমন সিপাহি, নায়েক, হাবিলদার, উপসহকারী
পরিদর্শক (এএসআই), উপপরিদর্শক (এসআই), পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) রয়েছে, তেমনই পদ-পদবি
রয়েছে আরএনবিতেও। ইন্সপেক্টর পদের ওপরের ধাপগুলো হচ্ছে–
সহকারী কমান্ড্যান্ট, কমান্ড্যান্ট ও চিফ কমান্ড্যান্ট। রেলওয়ের দুই অঞ্চলে রয়েছেন
দু’জন চিফ কমান্ড্যান্ট। পূর্বাঞ্চলের চিফ কমান্ড্যান্ট আশাবুল ইসলাম।
এর আগে দায়িত্ব পালন করেন জহিরুল ইসলাম। মূলত তিনি বাহিনীতে র্যাঙ্ক ও বদলি
বাণিজ্য শুরু করেন। তাঁকে পশ্চিমাঞ্চল হেডকোয়ার্টার রাজশাহীতে বদলি করে পূর্বাঞ্চলের
হেডকোয়ার্টার চট্টগ্রামের সিআরবিতে দায়িত্ব দেওয়া হয়। আগের চিফ কমান্ড্যান্টের
বিধিবহির্ভূত দেওয়া র্যাঙ্ক বাতিল না করে বহাল রেখেছেন তিনিও। স্বাভাবিকভাবে এ
নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিভিন্ন সময় বাহিনীর সিপাহি থেকে নায়েক, হাবিলদার থেকে এএসআই ও
এসআই থেকে ইন্সপেক্টর পদে পদোন্নতি ছাড়া শুধু ‘অনারেবল র্যাঙ্ক ব্যাজ’
প্রদানে পদভেদে লেনদেন হয় ১ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া মাদক কারবারি ও টিকিট
কালোবাজারির সঙ্গে যুক্ত আরএনবি সদস্যদের দেওয়া হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব।
বছরের পর বছর ঘুরেফিরে একই এলাকায়, অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ চৌকিগুলোতে থেকে নানাভাবে
উপরি আয় করছেন তারা, যার ভাগ যায় বাহিনীর শীর্ষ পর্যন্ত।
সাধারণত থানাগুলোতে দায়িত্ব পালন করেন
ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার কর্মকর্তা। তেমনি আরএনবির বিভিন্ন চৌকিতে দায়িত্ব পালন করেন
একজন করে ইন্সপেক্টর। পুলিশের কোনো থানায় ইন্সপেক্টর না থাকলে সিনিয়র
সাব-ইন্সপেক্টররা নিজের পদমর্যাদায় চেয়ারে বসে সাময়িক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে
অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করে থাকেন। আরএনবির নিয়মও একই। অবিশ্বাস্যভাবে
লোকবলশূন্যতার অজুহাতে পদোন্নতি ছাড়াই র্যাঙ্ক ব্যাজ দেওয়া হচ্ছে। নতুন এ নিয়মের
নাম দেওয়া হয়েছে ‘সম্মানীয় র্যাঙ্ক ব্যাজ’। অভিযোগ উঠেছে, এভাবে ব্যাজ
দিয়ে চলে লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য। অন্যদিকে, সিনিয়রদের বাদ দিয়ে তুলনামূলক অনেক জুনিয়রকে
টাকার বিনিময়ে র্যাঙ্ক ব্যাজ দেওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে বাহিনীতে অসন্তোষও বিরাজ করছে।
বাহিনীর বিভিন্ন চৌকিতে দায়িত্বে থাকাকালে
বিভিন্ন সময় সিপাহি থেকে নায়েক করা হয়েছে মাহফুজুর রহমান, আনোয়ার হোসেন, আতিকুর
রহমান, ইকবাল হোসেন ও সুলতান সরকারকে। হাবিলদার থেকে এএসআই করা হয়েছে হাবিবুর
রহমান, পান্না লাল দে, রতন হোসেন, সুনীল বাবু, জহিরুল ইসলাম, জানে আলম, ফারুক
হোসেন, ইসরাফিল ও মাহমুদুর রহমানকে। এ ছাড়া এসআই থেকে ইন্সপেক্টর করা হয়েছে আবু
সুফিয়ান, এসএম তাজবীর, মাসুদুর রহমান ও আমিনুল হককে। এসআই থেকে একরামুল হক সিকদার,
মো. হাবিবুল্লাহ ও হাসান মোহাম্মদকে ইন্সপেক্টর পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়।
তাদের র্যাঙ্ক ব্যাজ দেওয়া হয়নি। পদভেদে ১ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন
হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে তিনজনকে ইন্সপেক্টর পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া
হলেও টাকা না দেওয়ায় তাদের ‘র্যাঙ্ক ব্যাজ’ দেওয়া হয়নি। নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে আরএনবির শীর্ষ পর্যায়ের
কয়েক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। এ নিয়ে দুদকের পক্ষ থেকে মামলাও করা হয়েছে; যার মধ্যে
নাম রয়েছে অভিযুক্ত আরএনবি কর্মকর্তা জহিরুল ইসলামেরও। এ বিষয়ে কয়েকজনের সঙ্গে
যোগাযোগ করা হলেও তারা কথা বলতে রাজি হননি।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বাহিনীর
সাব-ইন্সপেক্টর ও ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার কয়েক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, বাহিনীর
কোনো পদ খালি থাকলে জুনিয়র কর্মকর্তাদের সাময়িক অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়ার বিধান
রয়েছে। কিন্তু পদোন্নতি ছাড়া র্যাঙ্ক ব্যাজ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। লোকবলের
অভাবের বিষয়টিকে পুঁজি করে বিভিন্ন অঙ্কের অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে র্যাঙ্ক ব্যাজ
দেওয়া হয়েছে। একটি শৃঙ্খলাপরায়ণ বাহিনীতে এ ধরনের বিধি ভঙ্গের বিষয় ভাবাই যায় না।
এদিকে সাব-ইন্সপেক্টর থেকে ইন্সপেক্টর পদে র্যাঙ্ক
ব্যাজসহ অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদানে জ্যেষ্ঠতা মানা হয়নি জানিয়ে বাহিনীর চিফ
কমান্ড্যান্টের (পূর্ব) কাছে আবেদন করেন আরএনবির গোয়েন্দা শাখায় কর্মরত এসআই
জাহাঙ্গীর আলম। গত ২৫ নভেম্বরের আবেদনে তিনি জানিয়েছেন, ইন্সপেক্টর পদে অতিরিক্ত
দায়িত্ব প্রদানকালে জ্যেষ্ঠতা মানা হয়নি। নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারী জ্যেষ্ঠতা
ও পদোন্নতি বিধিমালা ২০১১ অনুযায়ী সাব-ইন্সপেক্টর একরামুল হক সিকদার, আবু সুফিয়ান,
মো. হাবিবুল্লাহ ও হাসান মোহাম্মদের চেয়ে তিনি জ্যেষ্ঠ হলেও তাঁকে ইন্সপেক্টর পদে
অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর চিফ কমান্ড্যান্ট (পূর্ব) আশাবুল ইসলাম বলেন, ‘লোকবলের
অভাবে শূন্য পদে কাজ চালিয়ে নিতে বাহিনীর সদস্যদের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। কাউকে
র্যাঙ্ক ব্যাজ দিইনি। শূন্য পদ পূরণে বাহিনীর বিভিন্ন পদে জ্যেষ্ঠতার তালিকা
করছি। তালিকা ধরে জ্যেষ্ঠ সদস্যদের দিয়ে শূন্য পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হবে।’
র্যাঙ্ক ব্যাজ বিক্রির অভিযোগে অভিযুক্ত জহিরুল
ইসলাম এখন রেলের পূর্বাঞ্চল থেকে পশ্চিমাঞ্চলে আরএনবির চিফ কমান্ড্যান্ট হিসেবে
দায়িত্ব পালন করছেন। অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে তাঁর মোবাইল ফোনে কয়েক দফায় চেষ্টা
করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।