বাজারের আস্থাহীনতায় দর হারাচ্ছে ‘ভরসার’ বহুজাতিক কোম্পানিও
অনেকটা
নিশ্চিত ভালো মুনাফা পেতে
বিনিয়োগকারীরা বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করেন। শুধু তাই নয়,
শেয়ার বাজারের গভীরতা বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখে
এই বহুজাতিক তথা ভালো কোম্পানিগুলো।
কিন্তু বাজারের আস্থাহীনতায় দর হারাচ্ছে বহুজাতিক
কোম্পানিগুলো। দর কমে গত
এক বছরের মধ্যে এখন সর্বনিম্ন অবস্থানে
এই কোম্পানিরগুলোর শেয়ারদর। গতকাল রোববার সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে দেশের প্রধান শেয়ার বাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে
(ডিএসই) মূল্যসূচকের পতনে ভূমিকা রেখেছে
তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও।
এদিন
ডিএসইতে তালিকাভুক্ত ১৩টি বহুজাতিক কোম্পানির
মধ্যে ১২টির দরই কমেছে। কিন্তু
কেন কমছে বহুজাতিক কোম্পানির
শেয়ারদর? বাজার বিশ্লেষকরা বলেছেন, দেশে গত বছর
জুলাই-আগস্টে আন্দোলনের পাশাপাশি অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করায় সামগ্রিকভাবে অন্যান্য
খাতের মতো নেতিবাচক প্রভাব
পড়েছে দেশে ব্যবসা পরিচালনা
করা বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর আয় ও মুনাফায়।
এছাড়া, অনেক ব্যাংক এখন
১২ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে। ফলে
বিনিয়োগকারীরা শেয়ার না কিনে ব্যাংকে
টাকা রাখছে। দেশি-বিদেশি অনেক
বড় বিনিয়োগকারী ডলার সংশ্লিষ্ট সম্পদে
বিনিয়োগ করছে। আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ক্রিপ্টো কারেন্সির
দর বাড়তির দিকে। তারা বলেছেন, গত
আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক
সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) পুনর্গঠন করা হলেও বিনিয়োগকারীদের
আস্থা ফেরাতে সংস্থাটি দৃশ্যমান কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ
নেয়নি। ফলে গত ৫
আগস্টের পর বিদেশি বিনিয়োগ
কিছুটা বাড়লেও গত নভেম্বর ও
ডিসেম্বরে আবার কমেছে। যার
নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ারদরেও।
বাজারের
লেনদেনের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা
যায়, ডিএসইতে গতকাল লেনদেনকৃত মোট ৪০৩টি কোম্পানির
মধ্যে দর বেড়েছে মাত্র
৭৫টির, কমেছে ২৬১টির। আর অপরিবর্তিত রয়েছে
৬৭টির দর। এর মধ্যে
তালিকাভুক্ত ১৩টি বহুজাতিক কোম্পানির
মধ্যে ১২টির দরই কমেছে। দর
কমা বহুজাতিক কোম্পানিগুলো হলো: ব্রিটিশ আমেরিকান
টোবাকো কো. (ব্যাটবিসি), বার্জার
পেইন্টস্, গ্রামীণফোন, লাফার্জহোলসিম, ম্যারিকো, বাটা, ইউনিলিভার, রবি, রেকিড বেনকাইজার,
লিন্ডেবিডি ও হাইডেলবার্গ সিমেন্ট।
অন্যদিকে দর বেড়েছে মাত্র
সিঙ্গারবিডি বাংলাদেশ লি.-এর। ডিএসইর
তথ্য বলছে, কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর এখন গত এক
বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে অবস্থান করছে। গতকাল ডিএসইতে লেনদেন শেষে ব্রিটিশ আমেরিকান
টোবাকো কো. বাংলাদেশ লি.
-এর সমাপনী দর ছিল ৩৪৫
টাকা ২০ পয়সা, বার্জার
পেইন্টসের ১৮১৫ টাকা ৮০
পয়সা, গ্রামীণফোনের ৩৩০ টাকা ১০
পয়সা, লাফার্জহোলসিমের ৪৯ টাকা ৮০
পয়সা, ম্যারিকোর ২৩০৪ টাকা ৬০
পয়সা, বাটা সুর ৮৭৬
টাকা ৭০ পয়সা, ইউনিলিভারের
২৫২৫ টাকা, সিঙ্গারের ১০৭ টাকা ৮০
পয়সা, রবির ২৭ টাকা
৬০ পয়সা, রেকিড বেনকাইজারের ৪১০৮ টাকা ৭০
পয়সা, হাইডেলবার্গ সিমেন্টের ২০৯ টাকা, আর
এ কে সিরামিকসে্র ২২
টাকা ১০ পয়সা ও
লিন্ডে বাংলাদেশের ৯৭৬ টাকা ২০
পয়সা। অন্যদিকে এক বছর আগে
এই সময়ে কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর
ছিল, ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো কো. বাংলাদেশ লি.
-এর ৫১৮ টাকা ৭০
পয়সা, বার্জার পেইন্টসের ২০০০, গ্রামীণফোনের ৩৮৭ টাকা, লাফার্জহোলসিমের
৭৭ টাকা ৮০ পয়সা,
ম্যারিকোর ২৬০০, বাটার ১০২৫ টাকা, ইউনিলিভারের
৩৩৭০ টাকা, সিঙ্গারের ১৬১ টাকা, রবির
৩৫ টাকা ৭০ পয়সা,
রেকিড বেনকাইজারের ৫২১৮ টাকা ১০
পয়সা, হাইডেলবার্গ সিমেন্টের ৩৭১ টাকা, আর
এ কে সিরামিকসে্র ৪২
টাকা ৬০ পয়সা ও
লিন্ডে বাংলাদেশের ১৮০০ টাকা।
বহুজাতিক
কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর সর্বনিম্ন অবস্থানে থাকা প্রসঙ্গে পুঁজিবাজার
বিশ্লেষক ও সরকারের বিনিয়োগ
প্রতিষ্ঠান আইসিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ গতকাল
ইত্তেফাককে বলেন, বহুজাতিক অনেক কোম্পানির আয়
কমেছে। এছাড়া, অনেক ব্যাংক এখন
১২ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে। ফলে
বিনিয়োগকারীরা শেয়ার না কিনে ব্যাংকে
টাকা রাখছে। তিনি বলেন, দেশি-বিদেশি অনেক বড় বিনিয়োগকারী
ডলার সংশ্লিষ্ট সম্পদে বিনিয়োগ করছে। আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ক্রিপ্টো কারেন্সির
দর বাড়তির দিকে। যার নেতিবাচক প্রভাব
পড়েছে এসব কোম্পানির শেয়ারদরে।
বাজার
সংশ্লিষ্ট-ব্যক্তিরা বলেছেন, দেশে গত বছর
জুলাই-আগস্টে আন্দোলনের পাশাপাশি অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করায় সামগ্রিকভাবে অন্যান্য
খাতের মতো নেতিবাচক প্রভাব
পড়েছে দেশে ব্যবসা পরিচালনা
করা বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর আয় ও মুনাফায়।
ফলে ২০২৪ সালের তৃতীয়
প্রান্তিক বা জুলাই-সেপ্টেম্বরে
বহুজাতিক কোম্পানির অর্ধেকেরও বেশি বিক্রয় থেকে
আয় কমেছে। এতে অধিকাংশ কোম্পানির
মুনাফা কমেছে। আর কোনো কোনোটি
লোকসানের সম্মুখীন হয়েছে। কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, সিঙ্গার
বাংলাদেশ, আরএকে সিরামিকস এবং হাইডেলবার্গ সিমেন্ট
গত বছরের একই সময়ে লাভে
থাকলেও এবার তৃতীয় প্রান্তিকে
লোকসানের খাতায় নাম লিখিয়েছে। ২০২৩
সালের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) লোকসানে থাকা বাটা-শু
চলতি বছরের একই সময়ে লোকসান
আরও বেড়েছে। যদিও তিন প্রান্তিক
মিলিয়ে কোম্পানিগুলো লাভে আছে। এছাড়া,
আগের বছরের তুলনায় মুনাফা কমেছে রেকিট বেনকিজারের, বিএটি বাংলাদেশের, ইউনিলিভার বাংলাদেশের, লাফার্জ হোলসিম বাংলাদেশ লি:-এর। তবে
একই সময়ে মুনাফা বৃদ্ধি
পাওয়া কোম্পানির মধ্যে রয়েছে গ্রামীণফোন, ম্যারিকো বাংলাদেশ, রবি আজিয়াটা, লিন্ডে
বাংলাদেশ।
কোম্পানির
আয় কমা প্রসঙ্গে লাফার্জ
হোলসিম বাংলাদেশ লি:-এর সিইও
মোহাম্মদ ইকবাল চৌধুরী সম্প্রতি ইকোনমিক রিপোর্টাস ফোরামের (ইআরএফ) এক অনুষ্ঠানে এই
প্রতিবেদকের এক প্রশ্নের উত্তরে
বলেন, বিশ্বব্যাপী ক্লিংকারের দর অনেক কমেছে।
আর লাফার্জহোলসিমের আয়ের একটি বড়
অংশ আসে ক্লিংকার বিক্রি
থেকে। ফলে ক্লিংকারের দাম
কমায় কোম্পানিটির আয় কমেছে। তবে
ক্লিংকারের দাম আবার আগের
জায়গায় এলে কোম্পানিটির আয়
বেড়ে যাবে।
বিদেশি
বিনিয়োগ কমেছে
অন্তর্বর্তী
সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত আগস্ট,
সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে বিদেশি
বিনিয়োগকারীদের শেয়ার কেনার প্রবণতা বাড়লেও গত দুই মাসে
কমেছে। স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই)
তথ্য অনুযায়ী, আগস্টে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা মোট ৮১২ কোটি
টাকা লেনদেন করে। যার মধ্যে
শেয়ার কেনে ৫৬৫ কোটি
টাকার এবং বিক্রি করে
২৪৬ কোটি টাকার শেয়ার।
সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরেও ক্রয়ের
এ প্রবণতা অব্যাহত থাকে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সেপ্টেম্বর মাসে ১৭০ কোটি
টাকার শেয়ার কেনেন এবং ১৬৬ কোটি
টাকার শেয়ার বিক্রি করেন। অক্টোবর মাসে তারা ১২৩
কোটি টাকার শেয়ার কেনেন এবং ৩৪ কোটি
টাকার শেয়ার বিক্রি করেন। অন্যদিকে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নভেম্বর মাসে ১৬৫ কোটি
টাকার শেয়ার কেনেন এবং ২০০ কোটি
টাকার শেয়ার বিক্রি করেন। ডিসেম্বর মাসে ৯৬ কোটি
টাকার শেয়ার বিক্রির বিপরীতে ৭৩ কোটি টাকার
শেয়ার কেনা হয়। এই
দুই মাসে মোট ৫৮
কোটি টাকার নিট উত্তোলন দেখা
যায়। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের
(ডিএসই) চেয়ারম্যান মোমিনুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি
ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্টস ফোরামের (সিএমজেএফ) অনুষ্ঠানে বলেছেন, ফ্লোর প্রাইস ও মুদ্রার অবমূল্যায়নের
কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাস কমে গেছে। তিনি
বলেন, ভালো মানের শেয়ারগুলো
এখন অবমূল্যায়িত। তবে আশা করছি,
পুঁজিবাজারে সংস্কার সম্পন্ন হলে আগামী জুনের
মধ্যে বাজার ভালো হবে।