আসছে মুদ্রানীতি, কী হবে আবারও নীতি সুদ বাড়লে

শীতকালীন সবজির দাম অনেকটাই সহনীয় পর্যায়ে চলে এসেছে। ফলে গত বছর অতিবৃষ্টিজনিত খাদ্য মূল্যস্ফীতির খড়্গ থেকে মানুষ স্বস্তি পেয়েছে। এখন জনমনে নতুন শঙ্কা আসন্ন পবিত্র রমজান মাস নিয়ে।

রমজান মাসে নিয়ম করে প্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম বেড়ে যায়, আমাদের স্মরণকালের ইতিহাস তা বলে। ফলে এবারও সেই শঙ্কা থাকা অমূলক কিছু নয়। সেই সঙ্গে ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে শুরু হচ্ছে রমজান। বাকি অর্ধেক পড়বে চৈত্র মাসে। এই সময় এমনিতেই বাজারে সবজি মাছের সরবরাহ কমে যায়। প্রাকৃতিক নিয়মেই তা হয়। এবার তার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে রোজা।

প্রায় তিন বছর ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। সেই সঙ্গে আছে এখনকার বিশেষ রাজনৈতিক বাস্তবতা। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অনিশ্চয়তার মধ্যে সাধারণত অর্থনীতির অধোগতি দেখা যায়। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশ ব্যাংক আবারও নীতি সুদহার বাড়ালে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে বলেই শঙ্কা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, অর্থবছরের প্রথম চার মাসের শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে দশমিক ৬৬। এই হার গত সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। শুধু তা- নয়, সময় শিল্পের প্রয়োজনীয় মধ্যবর্তী পণ্য মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিও কমেছে। ছাড়া ২০২৩ সালের জুলাই-নভেম্বরের তুলনায় ২০২৪ সালের একই সময়ে ভোগ্যপণ্য আমদানিরএলসি সেটেলমেন্টকমেছে ১৩ শতাংশ। অর্থাৎ ঋণপত্রের নিষ্পত্তি হয়েছে কম।

ভোগ্যপণ্যের আমদানি কমলে বাজারে জোগান কমে দাম বেড়ে যায়, এটাই অর্থনীতির চিরাচরিত নিয়ম। অন্যদিকে মূলধনি মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি কমলে অর্থনীতির ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যায়। সবকিছুর প্রভাব পড়ে প্রবৃদ্ধির ওপর। বিশ্বব্যাংকের মতে, চলতি অর্থবছরে যা দশমিক শতাংশে নামবে। সেটা হলে তা হবে দুই দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি, কেবল কোভিড১৯এর ২০২০-২১ অর্থবছর বাদে।

এই পরিস্থিতিতে জানুয়ারি মাসের শেষ ভাগে মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গত পাঁচ মাসে ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট করে তিন দফা নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে, বর্তমানে যা ১০ শতাংশ। নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হচ্ছে না, বরং এর প্রভাবে বাজারে সব ধরনের ঋণের সুদহার বেড়ে গেছে। বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদাও তলানিতে নেমে এসেছে, অর্থনীতিতে যার দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এখন একধরনের স্ট্যাগফ্লেশন (নিম্ন প্রবৃদ্ধি+ উচ্চ মূল্যস্ফীতি+ উচ্চ বেকারত্ব) চলছে অর্থনীতিতে। অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী মুদ্রানীতিতে কী পদক্ষেপ নেবে, সেটাই দেখার বিষয়।

তবে অনেকেই মনে করেন, উন্নত বিশ্বে সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হলেও আমাদের দেশে সম্ভব নয়। যেসব দেশের ৯০ শতাংশই ভোক্তাঋণ, সেখানে তা সম্ভব হতে পারে। তারা বাড়ি, গাড়িসহ নানা কাজে ঋণ নেন। ফলে সেসব দেশে সুদহার বাড়িয়ে ভোগব্যয় কমানো যায়। কিন্তু আমাদের দেশে ৮৫ শতাংশ ঋণই ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য নেওয়া হয়। এখানে সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়, সরকারি তথ্যেই যার প্রমাণ পাওয়া যায়। উল্টো বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি তলানিতে ঠেকেছে, অর্থাৎ দেশে বিনিয়োগ হচ্ছে না। জিডিপি প্রবৃদ্ধিও কমে সর্বনিম্ন অবস্থায় নেমেছে। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ১৫ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসায়ীদের পক্ষে ব্যবসা করা প্রায় অসম্ভব।

বিষয়ে ব্যবসায়ী নেতা শাশা ডেনিমসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ বলেন, বর্তমানে ব্যবসায়ী বিনিয়োগকারীদের আস্থা তলানিতে, এত খারাপ অবস্থা তিনি এর আগে দেখেননি। ছোট থেকে শুরু করে বড় সব শ্রেণির ব্যবসায়ী নগদ প্রবাহের ঘাটতিতে আছেন। সামনে রোজা দুটি ঈদ, কর্মীদের বোনাস দিতে হবে, তার সঙ্গে খেলাপি ঋণের নতুন নিয়মসব মিলিয়ে এই মুহূর্তে আবারও নীতি সুদহার বাড়ানো হলে রীতিমতো বিপর্যয় হতে পারে।

নীতি সুদ বৃদ্ধি করে এখন পর্যন্ত লাভ হয়নি উল্লেখ করে শামস মাহমুদের অভিযোগ, নীতি সুদ বৃদ্ধির কী প্রভাব পড়বে, তা খতিয়ে দেখা হয়নি। ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার সময়ও খতিয়ে দেখা হয়, সেই ঋণ ফেরত আসার সম্ভাবনা কতটুকু। কিন্তু নীতি সুদ বৃদ্ধির মতো গুরুতর সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তা করা হয় না। ছাড়া ভ্যাট বৃদ্ধি গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের সমালোচনা করেন তিনি।

বাস্তবতা হলো, নীতি সুদহার বাড়িয়ে বাজারে ডিমের সরবরাহ বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। ডিমের সরবরাহ না বাড়লে দামও কমবে না। ভোগপণ্য আমদানির বাজারে আরও প্রতিষ্ঠান নিয়ে আসতে হবে; তা না হলে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়বে না। এই ভরা মৌসুমে চালের দাম বেড়েছে। খোদ বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেছেন, সাময়িক মজুতদারি হয়েছে, কিন্তু এরপরও দাম কমছে না। সরকার এখন আমদানি বৃদ্ধি করে চালের দাম কমানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক আবারও নীতি সুদহার বাড়ালে আমদানি ব্যয় আরও বেড়ে যাবে। ডলারের বিনিময় হারও কিছুদিন স্থিতিশীল থাকার পর সম্প্রতি বাড়তে শুরু করেছে।

এদিকে গভর্নর আহসান মনসুর ঢাকা চেম্বারের পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে এক বৈঠকে বলেছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এতে শিগগিরই বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। আসন্ন পবিত্র রমজান মাসে পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে কোনো ধরনের মার্জিন ছাড়াই ঋণপত্র খুলতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

মুদ্রানীতি প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, নীতি সুদহার বাড়িয়ে এখন পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। মূল্যস্ফীতির মূল কারণ নিরূপণ না করে এভাবে নীতি সুদ বাড়িয়ে লাভ হয়নি। চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির মূল কারণ চাহিদাজনিত নয়, বরং সরবরাহজনিত।

নীতি সুদ বাড়ানোর পাশাপাশি ভ্যাট বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এতে নীতি সুদ বৃদ্ধির ফল পাওয়া যাচ্ছে না বলে মনে করেন সেলিম রায়হান। তাঁর মতে, মুদ্রানীতি, রাজস্ব নীতি বাজার ব্যবস্থাপনার সমন্বয়ের মাধ্যমে এগোতে হবে। তা না করে কেবল নীতি সুদ বাড়ানো হলে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে; এর জেরে প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় প্রভাব পড়বে।

বাস্তবতা হলো, চাহিদা কমিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর নীতি কাজে আসেনি। নীতি সুদহার বাড়ানো হবে আবার ভ্যাটও বাড়ানো হবে, এই পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি কমবে না। এতে মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হবে। দরকার হচ্ছে, সামগ্রিক চাহিদা বাড়ানো। এমনিতেই দেশে প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে আবারও নীতি সুদহার বাড়ালে চাহিদায় আরও প্রভাব পড়বে।