সংকটের চোরাবালিতে অর্থনীতি
অর্থপাচার, দুর্নীতি, দুঃশাসন ও লুটপাটে বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে টেনে তোলার চ্যালেঞ্জ নিয়ে যাত্রা শুরু করছে নতুন বছর। রাজনৈতিক অস্থিরতায় ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা, শিল্পে শ্রম অসন্তোষ, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক ধারা, বিপুল খেলাপি ঋণ, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলারের বাজারে অস্থিরতার মতো পুরনো সংকটগুলো নতুন বছরেও অর্থনীতিকে ভোগাবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা। তাঁরা বলছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আর সরকারের নীতিগত পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করবে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার।
খাতসংশ্লিষ্ট
ব্যক্তিরা বলছেন, ব্যাপকভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের ফলে শিল্প খাতের
সংকট হবে আরো প্রকট,
চড়া মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমুখী
মুদ্রানীতি অনুসরণের ফলে বাজারে টাকার
প্রবাহ আরো কমবে, বাড়বে
ঋণের সুদ হার, বাধাগ্রস্ত
হবে বিনিয়োগ, কমবে নতুন কর্মসংস্থানের
গতি।
অর্থনৈতিক
মন্দায় রাজস্ব আয় বাড়ানো, ব্যাংক
খাতের দুর্বলতা দূর করে সবল
করা এবং আর্থিক খাতে
সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা হবে অন্তর্বর্তী
সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
বিদায়ি
বছরের মতো উচ্চ মূল্যস্ফীতি
নতুন বছরেও ভোগাবে বলে মনে করা
হচ্ছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সার্বিক
মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশের
বেশি। এই মূল্যস্ফীতির হিসাব
নিয়ে বিতর্ক ছিল।
সরকার
পরিবর্তনের পর এই মূল্যস্ফীতি
গড়ে ১১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি সর্বশেষ ১৩.৮৮ শতাংশে
পৌঁছেছে। কিন্তু জাতীয় মজুরি হার কয়েক মাস
ধরেই ৮ শতাংশের ঘরে
আটকে আছে। মূল্যস্ফীতির তুলনায়
মানুষের আয় কম হারে
বাড়ায় মানুষের কষ্ট বাড়ছে।
ক্ষমতায়
নতুন সরকার আসার পর সুদের
হার বাড়িয়ে, কিছু শুল্ক কমানোসহ
অন্যান্য পদক্ষেপ নিলেও মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরা
যায়নি। পরে টাকা ছাপিয়ে
পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়েছে। নতুন
বছরেও টাকা ছাপা অব্যাহত
থাকলে মূল্যস্ফীতি আরো অসহনীয় হয়ে
উঠবে বলে মনে করছেন
অর্থনীতিবিদরা।
বেসরকারি
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের
নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত দুই-তিন
বছরে অর্থনীতি যে পরিমাণ অবনমিত
হয়েছে, তার ধারাবাহিকতা আগামী
বছরও বজায় থাকবে। অর্থনৈতিক
পরিস্থিতি যতটা খারাপ অবস্থায়
গেছে, সেটা টেনে তুলতে
সময় লাগবে।
জুলাই
অভ্যুত্থানের পর অর্থ মন্ত্রণালয়
এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশ কিছু পদক্ষেপ
নিয়েছে। মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ কমে যাওয়া, আর্থিক
খাতের লুটপাট, বিনিয়োগে স্থবিরতা—সব কিছু মিলিয়ে
ম্যাক্রো ইকোনমি বা সামষ্টিক অর্থনীতিটা
দুর্বল হয়েছে। অভ্যুত্থানের পর নেওয়া সব
পদক্ষেপই যে ফলপ্রসূ হচ্ছে
তা কিন্তু নয়। নীতি সুদহার
বাড়িয়ে মুদ্রা সংকোচন নীতির মাধ্যমে বাজারে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করছে সরকার। কিন্তু
সেটা সফলতা আনেনি। উল্টো মুদ্রাস্ফীতি বেড়েই চলছে। শুধু মুদ্রানীতি সংকোচনের
মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমানো যাবে না। মানুষের
চাহিদা কিংবা বিনিয়োগ কোনোটিই বাড়েনি। দুই বছর আগে
থেকেই বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনের ভারসাম্য নেতিবাচক ছিল। রপ্তানি ও
আমদানি পার্থক্য কমিয়ে আনার লক্ষ্য ছিল।’
ফাহমিদা
খাতুন আরো বলেন, এমনিতেই
বিনিয়োগ কম হচ্ছে, তার
ওপর সুদহারও অনেক বাড়ানো হয়েছে।
ফলে বিনিয়োগ আরো কমবে। ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে সবচেয়ে
বেশি ভুগবে ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো। এই পরিস্থিতি
সামলে উঠতে হবে। ব্যাংক
খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে শক্ত পদক্ষেপ
নিতে হবে। শুধু এই
১০ ব্যাংক নয়, আরো অনেক
ব্যাংকের অবস্থাই নাজুক। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করতে হবে।
ভোগাবে
খেলাপি ঋণ
ব্যাংক
খাতে খেলাপি ঋণ ছয় মাসের
মধ্যে বর্তমানের দ্বিগুণের কাছাকাছি ঠেকবে বলে সতর্ক করেছেন
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। তিনি
বলেন, ‘আমরা দেশের আর্থিক
খাতের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছি। সামনে খেলাপি ঋণ ২৫ থেকে
৩০ শতাংশে পৌঁছে যাবে, এখন যা সাড়ে
১২ শতাংশ। আগামী মাসে তা ১৫
শতাংশ, এরপর ১৭ শতাংশ
হয়ে ধীরে ধীরে ৩০
শতাংশে পৌঁছে যেতে পারে। এই
খেলাপি আগেই হয়ে আছে।
এখন তা হিসাবে আসবে।
এটা কমিয়ে আনতে আমরা কাজ
শুরু করেছি।’
আন্তর্জাতিক
মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মানলে সামষ্টিক
খেলাপি ঋণের পরিমাণ পাঁচ
লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে
যেতে পারে—এমন আশঙ্কা
প্রকাশ করেছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সংস্থাটি খেলাপি ঋণের সংজ্ঞায় পরিবর্তন
আনার পরামর্শ দেওয়ায় এবং ঋণ পুনঃ
তফসিলের নীতিমালাকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করার পরামর্শের কারণে
এই ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। আওয়ামী
লীগ সরকারের আমলে অনিয়মের মাধ্যমে
বিতরণ করা ঋণগুলো এখন
একে একে খেলাপি হয়ে
যাচ্ছে। এতে বাড়ছে আর্থিক
খাতের এই নেতিবাচক সূচক।
রপ্তানি
প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা বড় চ্যালেঞ্জ
পোশাক
খাতে শ্রম অসন্তোষসহ নানামুখী
সংকটে আগামী দিনে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি
ধরে রাখা চ্যালেঞ্জ হবে
বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট
ব্যক্তিরা।
তৈরি
পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নতুন বছরে তৈরি
পোশাক খাতের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা চ্যালেঞ্জিং
হবে। আমাদের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দেশের ইমেজ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত
করেছিল। নিরাপত্তার কারণে আমাদের অনেক মালিক ঠিকমতো
কারখানা চালাতে পারেননি। এসব কারণে বায়ারদের
কনফিডেন্স কিছুটা কমে গেছে। সেই
সঙ্গে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন
পক্ষের নানা রকম ষড়যন্ত্র
রয়েছে। এসব কিছু ফেস
করে রপ্তানিকে ট্র্যাকে আনা বড়ই চ্যালেঞ্জ
ছিল।’
ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা
বিভিন্ন
শিল্প গ্রুপ, মাঝারি ও ছোট উদ্যোক্তাদেরও
ব্যবসা-বাণিজ্যে অচলাবস্থা নেমেছে। ব্যবসায়ীদের এলসি নেই বললেই
চলে। অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দিয়েছেন।
মুদি দোকান-ফুটপাতে বেচাকেনা নেই। ব্যবসা না
থাকায় মানুষের মধ্যে অর্থের প্রবাহও নেই। দেশে নতুন
বিনিয়োগ আসছে না। কর্মসংস্থান
বাড়াছে না। ডলার সংকট,
ঋণের উচ্চ সুদহারের প্রভাব
নতুন বছরেও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই দুরবস্থার প্রভাব
নতুন বছরেও থাকতে পারে।
তৈরি
পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নীতি সুদহার বাড়া
মানে ব্যাংকঋণের সুদহার বাড়া। নীতি সুদহার বাড়ানোর
ফলে সেটা আরো বেড়ে
গেছে। এখন নতুন বিনিয়োগ
দূরের কথা, টিকে থাকার
সংগ্রামে লিপ্ত ব্যবসায়ীসমাজ। যখন ব্যাংকের সুদহার
বেড়ে যায় তখন সব
হিসাব ওলটপালট হয়ে যায়। কারণ
কিস্তির পরিমাণ বেড়ে যায় এবং
মুনাফার হার কমে আসে।’
বিশ্বব্যাংক
ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে
এক ধরনের অনিশ্চয়তা চলছে। আগামী এক-দেড় বছরে
রাজনীতি কোন দিকে যায়,
তা নিয়ে চিন্তায় আছেন
ব্যবসায়ীরা। আবার কারা ক্ষমতায়
যেতে পারে, তা-ও তাঁরা
বিবেচনায় রাখছেন। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে
হলে ব্যবসায়ীদের আস্থায় আনতে হবে।’
বৈশ্বিক
সংস্থার যেসব পূর্বাভাস
ফিচ
: বৈশ্বিক ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা ফিচ রেটিংয়ের মূল্যায়নে
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পূর্বাভাস নেতিবাচক হিসেবেই বহাল থাকছে। সম্প্রতি
প্রকাশিত এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের (এপিএসি) সার্বভৌম আউটলুকে এমন পূর্বাভাস দিয়েছে
সংস্থাটি।
এসঅ্যান্ডপি
গ্লোবাল, মুডিস : বৈশ্বিক ঋণমান নির্ণয়কারী আরো দুই বড়
প্রতিষ্ঠান যথাক্রমে এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল এবং মুডিস ইনভেস্টর
সার্ভিসও বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়েছে।
আইএমএফ
: আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল জানিয়েছে, বাংলাদেশের দুর্বল অর্থনীতি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আরো আশঙ্কাজনক
অবস্থায় আছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে
আসছে না। বরং যে
হার চলছে তা আইএমএফের
ধারণার চেয়েও অনেক বেশি। আইএমএফ
জানায়, গণ-অভ্যুত্থান, বন্যা
এবং কঠোর নীতির কারণে
২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রকৃত
জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে ৩.৮
শতাংশ হবে বলে অনুমান।
বিশ্বব্যাংক
: চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে ৪ শতাংশের
মধ্যে থাকবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে
বিশ্বব্যাংক।
অর্থনীতিবিদরা
যা বলছেন
বেসরকারি
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের
(সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেছেন, ‘আগামী দুই বছর দেশের
অর্থনীতিতে তিন ধরনের ঝুঁকি
থাকবে। পাশাপাশি দুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি. উচ্চ করহারসহ ১৭
ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত থাকবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য।’
বেসরকারি
গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নতুন বছর আমরা
কঠিন অর্থনৈতিক বাস্তবতার মধ্য দিয়ে শুরু
করছি। একদিকে আড়াই বছর ধরে
চলমান সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যাপক সমস্যা—যেখানে মূল্যস্ফীতি, ব্যালান্স অব পেমেন্ট, ফরেন
এক্সচেঞ্জ প্রাইস, সেই সঙ্গে ব্যাংকিং
খাত নিয়ে আমরা কঠিন
সমস্যায় আছি। মূলত বিগত
সরকারের আমলের অনেক পলিসি এবং
দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার কারণে অনেক সমস্যার সৃষ্টি
হয়েছে। বাজারে পণ্যের সাপ্লাই বা জোগান বাড়াতে
হবে। আমদানির বিভিন্ন বিধি-নিষেধের কারণে
স্বাভাবিক অবস্থার তুলনায় তা অনেক কম
এবং বাজারের জোগানকে সেগুলো অনেক নেগেটিভলি প্রভাবিত
করছে। সে কারণেই মূল্যস্ফীতির
ঊর্ধ্বগতি।’
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘এখন আমদানি স্বাভাবিক
করতে গেলে কিন্তু আবার
ফরেন এক্সচেঞ্জ স্ট্যাবিলাইজেশন এবং ফরেন রিজার্ভ
এখন যে অবস্থায় আছে,
তার চেয়ে আরো শক্তিশালী
অবস্থায় যেতে হবে। তাই
মূল্যস্ফীতি খুব দ্রুতই কমবে
না। অতি সম্প্রতি কেন্দ্রীয়
ব্যাংক ২২ হাজার কোটি
টাকা ছাপিয়েছে ছয়টি ব্যাংককে টিকিয়ে
রাখার জন্য। সেই জায়গায় আমরা
আশা করব—বাংলাদেশ ব্যাংক
গত পাঁচ মাসে যে
বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়েছে, সেভাবেই খুব সুচিন্তিত কিছু
পদক্ষেপ নিয়ে এগুলোর ক্ষত
অ্যাসেস করে রিকভারি প্ল্যান
তৈরি এবং যেটা রিকভারি
করার ফিজিবিলিটি নেই তাদের মার্জার
অ্যাকুইজিশনের মাধ্যমে একীভূত করে কিভাবে ডিপোজিটরদের
স্বার্থ রক্ষা করা যায় সেদিকটা
দেখবে। মূল্যস্ফীতির কারণে কস্ট অব বিজনেস
বেড়ে গেছে, মার্কেটে চাহিদা কমে গেছে, ইন্টারেস্ট
রেট বেড়েছে, এলসি করতে পারছেন
না ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা।
তাঁদের দিকে বিশেষ নজর
দিতে হবে।’