‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’-এর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন সম্প্রতি আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ শিরোনামে অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে। বিগত সাড়ে ১৫ বছরে দেশে সংঘটিত বিভিন্ন গুমের ঘটনায় নির্দেশদাতা হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে কমিশন। প্রতিবেদনে হাসিনা প্রশাসনের অন্তত চারজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তার গুমের ঘটনায় সম্পৃক্ততার কথাও বলা হয়। একইসঙ্গে এসব ঘটনায় জড়িতদের বিচারিক প্রক্রিয়া শুরুসহ র‍্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসনের অন্যতম চিহ্ন লাগাতার গুমের ঘটনা। আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুমের ঘটনায় কমিশনে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৬৭৬টি অভিযোগ জমা পড়েছে। কমিশন ৭৫৮ জনের অভিযোগ যাচাই-বাছাই করেছে, এর মধ্যে ৭৩ শতাংশ ভুক্তভোগী বাড়ি ফিরতে পেরেছেন। বাকি ২৭ শতাংশ বা অন্তত ২০৪ জন মানুষ এখনও নিখোঁজ আছেন। হাসিনা সরকারের পতনের পর পত্রপত্রিকায় গোপন বন্দিশালা বা আয়নাঘরের নানা বৃত্তান্ত আমরা জেনেছি। গুম হওয়া মানুষেরা বিনা বিচারে বছরের পর বছর আয়নাঘরে বন্দি থাকতেন। অতি ক্ষুদ্র পরিসরের  অমানবিক এই বন্দিশালায় জোরপূর্বক তাদের রাখা হতো। আয়নাঘর নামে পরিচিত এ গোপন বন্দিশালার অবস্থান ডিজিএফআইয়ের সদরদপ্তরের মধ্যে। এটি একসময় জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল (জেআইসি) হিসেবে ব্যবহৃত হতো। গুম তদন্ত প্রতিবেদনে শিউরে ওঠার মতো তথ্য রয়েছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে গুমের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে যারা এখনও নিখোঁজ, তাদের হত্যা করা হয়েছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের মাথায় গুলি করে লাশ সিমেন্টের ব্যাগ বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হতো (সমকাল, ১৬.১২.২৪)।

গুম-কমিশনের প্রতিবেদন কেউ না পড়লেও তার বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় যে, গত দেড় দশকে শেখ হাসিনার নির্দেশ ছাড়া দেশে একের পর এক গুম হতে পারত না। তাঁর আমলে সকল সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করবার এখতিয়ার এককভাবে তাঁর-ই ছিল। এখন সেই অমোঘ প্রশ্ন দেশের প্রাচীন ও অন্যতম প্রধান জনভিত্তির একটি রাজনৈতিক দলের নেত্রী হিসেবে কেন শেখ হাসিনা গুম ও খুনের নির্দেশদাতা হয়ে উঠলেন?

শেখ হাসিনা কালক্রমে অগণতান্ত্রিক, স্বেচ্ছাচারী ও কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছিলেন। প্রথম দুই দফা ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। সেই দুইবার সংসদে শক্তিশালী প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সরব উপস্থিতি ছিল, যা খুশি তা করবার সুযোগ পাননি শেখ হাসিনা। কিন্তু ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ পরপর তিনবার, নিজ দলের অধীনে একক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নিজেদের ইচ্ছেখুশির সংসদ বানিয়ে বসে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনকে হাস্যকর করে তুলবার পাশাপাশি শেখ হাসিনা নিজেকে সকল প্রশ্নের ঊর্ধ্বে স্থাপন করে বসেন! এই কাজে স্তাবক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ নানা শ্রেণি-পেশার অনেকেই শেখ হাসিনার সঙ্গী হন। এমন কর্তৃত্ববাদিতার যুগেও ভিন্নমত ও বিরোধী কণ্ঠস্বর প্রতিবাদের চেষ্টা করেছে। প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করবার হাতিয়ার হয়ে ওঠে গুম। কখনও বিচারবহির্ভূত হত্যা।

এ সত্যও আমাদের মনে রাখা দরকার, শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর আমরা পত্রপত্রিকায় যত খোলামেলা সে সময়কালের গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা বা আয়নাঘর সম্পর্কে জানতে পারছি; শেখ হাসিনার শাসনামলে এসব কানাঘুষোর মধ্যেই শূন্যে মিলিয়ে যেত। মায়ের ডাকসহ কয়েকটি সংগঠন রাজপথে সরব থেকেছে, এই কথা মনে রেখেও বলতেই হয়, ভিন্নমতের মানুষদের শেখ হাসিনা সরকার দমনপীড়নের চূড়ান্ত করেছে। আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ প্রতিবেদন অনুযায়ী সরকার নিশ্চয়ই গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনা ও সহযোগী হিসেবে অন্যদের পূর্ণাঙ্গ স্বরূপ জনগণের সামনে উন্মোচন করে যথার্থ বিচারের ব্যবস্থা করবে।

কিন্তু সরকার পতন হলে, বদলে গেলে বা পরিবর্তন হলেই কি কেবল আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ বা সত্যের উন্মোচন প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে? সরকার চলমান থাকা অবস্থায় সত্যের উন্মোচন সম্ভব নয়? যে বিষয়গুলো আপত্তিকর ও সাধারণ মানুষের কাছে প্রশ্নের উদ্রেক করে সেগুলো নিয়ে সরকারের পক্ষে স্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রয়োজন। এটিই ন্যূনতম জবাবদিহি; এর অনুপস্থিতি নাগরিকদের মধ্যে অসন্তোষ এবং সরকারের মধ্যে দমিয়ে রাখার প্রবণতা বাড়িয়ে তোলে।

০২.
৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রথম দিন থেকেই সরকারে জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান ও ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সর্বশেষ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের আগে এক জামায়াত নেতা বলে বসেন, ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বরের আগে ভারতীয়রা এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে! জামায়াতের প্রধান নেতারা প্রায়ই দেশের গণতন্ত্র, নির্বাচনসহ নানা বিষয়ে কথা বলছেন, সরকারের সঙ্গে সংলাপে অংশ নিচ্ছেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যাকারী রাজনৈতিক দল জামায়াত সাড়ম্বরে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কথা জাতিকে বলেই যাচ্ছে, এ এক চরম পরিহাস বৈকি! সরকারি বিভিন্ন পদ-পদবিতে জামায়াতের অবস্থান ও তাদের প্রতি সরকারের সদয় প্রশ্রয় নানা প্রশ্ন ও উদ্বেগের সৃষ্টি করছে।

শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক একের পর এক এমন সব কাণ্ড করছেন, তাতে প্রশ্ন জাগে কোন পক্ষকে প্রশ্রয় দিতে তিনি এ ধরনের আচরণ করছেন? প্রথমে তিনি একটি দলের নাটক মাঝপথে বন্ধ করে দিয়ে বললেন, আরও বড় যুদ্ধের জন্য তিনি আপাতত ছোট আপস করেছেন! কোন সে বড় যুদ্ধ? মামুনুর রশীদের মতো বরেণ্য শিল্পীকে শিল্পকলায় নিষিদ্ধকরণ তাঁর বড় যুদ্ধ? সর্বশেষ মহাপরিচালক সরকারি প্রতিষ্ঠান শিল্পকলা একোডেমিতে ডিসেম্বর মাসজুড়ে  আয়োজন করে তার নাম দেন ডিসেম্বর উৎসব! কেন বিজয় উৎসব নয়? ডিসেম্বরকে বিজয়ের মাস হিসেবে মেনে নিতে কাদের আপত্তি এ দেশের মানুষের তা অজানা নয়। তাদেরই কি খুশি করতে আগ্রহী শিল্পকলার মহাপরিচালক? পত্রিকায় বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে যাবতীয় প্রচারণায় ডিসেম্বরের উৎসব ব্যবহৃত হবার পর সমালোচনার মুখে শিল্পকলার মহাপরিচালক বিজয় দিবসের সকাল ১০টায় উৎসবের নাম পরিবর্তন করে বিজয় উৎসব করে সাংবাদিকদের পাঠানো খুদেবার্তায় বলেন, আমরা শেখ হাসিনার মুক্তিযুদ্ধের মনোলিথিক জায়গা থেকে নিজেদের সরিয়ে নিতে চাই। যদি মানুষ বিজয়ের উৎসব দেখতে চায়, আমরা সেই ধারণাকে সাদরে গ্রহণ করি। কিন্তু একই সঙ্গে আমরা সকল শিল্পকর্ম এবং পরিবেশনায় নিজেদের উপস্থাপনার মাধ্যমে শেখ হাসিনার একচ্ছত্র মনোভাবের বিরোধিতা করি। মানুষ যদি বিজয়ের উৎসব দেখতে চায়? মুক্তিযুদ্ধের বিজয় উৎসব মানুষ দেখতে চাইবে কিনা, তা নিয়ে মহাপরিচালকের দ্বিধা! মুক্তিযুদ্ধের বিজয় উদযাপন শেখ হাসিনার মনোলিথিক জায়গা? তিনি, মহাপরিচালক, মুক্তিযুদ্ধকে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করেন? হায়!

সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইতে একটি কবিতা যুক্ত করবার সিদ্ধান্ত হয়েছে। চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পটভূমিকায় রংপুরের শহীদ আবু সাঈদকে নিয়ে লেখা কবিতাটির এক অংশ কওমি তরুণ দাঁড়ায়া ছিল/ কারবালারই ফোরাতে/ শাহাদাতের আগুন দিয়া/ খুনির আরশ পোড়াতে। ...রংপুরে নদীর অভাব হলো, ফোরাতকে কেন এখানে হাজির করা হচ্ছে! জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে বাংলা-ইংরেজি-আরবি সব মাধ্যমের স্কুল-কলেজের ছাত্রদের অবিস্মরণীয় অংশগ্রহণ ছিল। কবিতায় কওমি ছাত্রদেরই শুধু প্রাধান্য দেওয়ায় অবশ্যই প্রশ্ন জাগে। সপ্তম শ্রেণির শিশু-কিশোরদের আমরা এই কবিতায় কোন রাজনীতির গহ্বরে নিক্ষেপ করছি? শাহাদাতের আগুন, খুনির আরশ! হায়, দুঃখিনী বাংলা ভাষা!
প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির বইয়ের শুরুতে জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত উৎকীর্ণ ছিল। এখন তা বইয়ের শেষে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এটিই বা কেন? জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীতের প্রতি কাদের এত বীতরাগ?                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                       
০৩.
রাগ-অনুরাগ বা বীতরাগ
 সরকার যখন একটি পক্ষ; তখন তাকে নিশ্চিতভাবে এসবের ঊর্ধ্বে থাকতে হয়, হবে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পাকিস্তানি অপশাসন ও শোষণ থেকে বাঙালির রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে এই ডিসেম্বর মাসে। পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তির মাধ্যমে যে স্বাধীন দেশ আমরা পেয়েছি, তার পেছনে আছে লাখ লাখ মানুষের আত্মত্যাগ, অমিত বীরত্বগাথা। মুক্তিযুদ্ধ কোনো দলের সম্পদ নয়, সমগ্র জাতির অর্জন দেশের স্বাধীনতা। গণতান্ত্রিক কাঠামোয় সকল পক্ষের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে  পরমতসহিষ্ণু ও বহুমতের সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব। গণতান্ত্রিক সমাজেই কেবল ভিন্নমত যথাযথ মর্যাদায় উচ্চারিত হতে পারে।

মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল; সাহিত্যিক