কূটনৈতিক সমাধানই সবচেয়ে ভালো বিকল্প
ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা, ভাঙচুর ও জাতীয় পতাকা নিয়ে টানাহেঁচড়ার ঘটনা ভিয়েনা কনভেনশনের পরিপন্থি। যখন এ ধরনের ঘটনা ভারতের বিরুদ্ধে ঘটে, তখন তারা নিজেই এর সমালোচনা করে– সংশ্লিষ্ট দেশ কেন নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। বিশেষ করে আমরা দেখেছি, কানাডা ও ইংল্যান্ডে মন্দিরে হামলার পর ভারত দুই দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। সেই ভারতেই কীভাবে বাংলাদেশের হাইকমিশন আক্রান্ত হলো?
স্বাভাবিকভাবেই এ ঘটনার ব্যাপক প্রতিক্রিয়া আমরা এদেশে দেখছি। রাজনৈতিক দলগুলো, ছাত্র সংগঠনগুলো তো বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেই; পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বেশ কড়াভাবে এর নিন্দা করেছে। সেখানে বলা হয়, প্রাপ্ত তথ্য চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করে– বিক্ষোভকারীরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনের প্রধান ফটক ভেঙে প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে। এ সময় স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের উপস্থিতিতে তারা পতাকার খুঁটি ভাঙচুর; বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অবমাননা এবং সহকারী হাইকমিশনের অভ্যন্তরের সম্পত্তিও ক্ষতিগ্রস্ত করে। দুঃখের বিষয়, হাইকমিশন প্রাঙ্গণ রক্ষার দায়িত্বে থাকা স্থানীয় পুলিশ সদস্যরা শুরু থেকেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ভূমিকা রাখেনি। সহকারী হাইকমিশনের সব সদস্য ভুগছেন নিরাপত্তাহীনতায়। যদিও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতিতে বলেছে, আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশন প্রাঙ্গণে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা খুবই দুঃখজনক। তারা ইতোমধ্যে কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করেছে। সেই সঙ্গে হামলায় জড়িত থাকার সন্দেহে সাতজনকে আটক করা হয়েছে।
বস্তুত কয়েক দিন ধরে দু’দেশের নাগরিকদের মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা দেখছি। জাতীয় পতাকা অবমাননা ঘিরে এ সংকট তৈরি হয়। ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ আছে। তবে আগরতলায় হাইকমিশনে হামলার ঘটনাটি উদ্বেগের। কারণ সাধারণভাবে সবাই তার দেশে থাকা অন্যান্য দেশের দূতাবাসের সুরক্ষা নিশ্চিত করে থাকে। দুই দেশের বিষয়াদি নিয়ে নাগরিকদের মধ্যে ক্ষোভ থাকা অস্বাভাবিক নয়। এ জন্য নাগরিকরা প্রতিবাদ জানাতেই পারে। তাই বলে সেটাকে দূতাবাসে হামলা পর্যন্ত গড়াতে দেওয়া যায় না।
বাংলাদেশের জন্যও এটা শিক্ষণীয়। এখানেও প্রতিবাদ হচ্ছে। নাগরিকের প্রতিবাদের অধিকার আছে। তবে কোনোভাবেই যেন ভারতীয় কোনো হাইকমিশন আক্রান্ত না হয়। বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে নিরাপত্তা জোরদার করেছে। তবে এখানেই করণীয় শেষ নয়। ভারতের মিডিয়ায় বাংলাদেশ নিয়ে এক ধরনের অপপ্রচার দেখা যাচ্ছে। একই সঙ্গে ভারতের পক্ষ থেকে সংখ্যালঘু নির্যাতনের যে অভিযোগ উঠছে, সেটিও আমাদের পক্ষ থেকে ‘অ্যাড্রেস’ করতে হবে। এ জন্য আমি মনে করি, ভারতের মিডিয়া ও তাদের নেতৃস্থানীয়দের বাংলাদেশে আহ্বান করা যেতে পারে। আপনারা মানুষের কথা শুনে ভুলভাল খবর না দিয়ে বাংলাদেশে এসে বাস্তব পরিস্থিতি দেখে যান। কেবল ভারতের প্রতিনিধি দলই নয়, এ জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও সরকার আহ্বান জানাতে পারে। যাতে তারা সরেজমিন এসে বাস্তবতা দেখতে পারে। এদিকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। তিনি বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রসঙ্গে বলেছেন, জাতিসংঘ যেন বাংলাদেশে শান্তি সেনা পাঠায়। আমার মনে হয় না, তাঁর এ বক্তব্যে গুরুত্ব দেওয়ার কিছু আছে। কারণ এটা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থান নয়। বরং ব্যক্তি মমতা রাজনীতিবিদ হিসেবে এ বক্তব্য দিয়েছেন। এটাকে আমরা তাঁর ব্যক্তিগত অবস্থান হিসেবেই দেখব।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক আছে। স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণেও মানুষ ভারতে যান। এ ছাড়া আরও যেসব সংযোগ দুই দেশের মধ্যে রয়েছে; সম্পর্কের তিক্ততা ও সেখানে প্রভাব পড়া স্বাভাবিক। ইতোমধ্যে তার কিছু লক্ষণও দেখা যাচ্ছে।
তবে এ সংকট আর বাড়তে দেওয়া উচিত হবে না। তাদের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যা করণীয়, তাই করা দরকার। ভারত প্রতিবেশী হিসেবে তো বটেই, আমি মনে করি, যে কোনো দেশের সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক থাকা দরকার। সম্পর্ক খারাপ হলে আমরাই সমস্যায় পড়তে পারি। তবে সম্পর্ক যাতে এমন না হয়– তারা আমার মাথার ওপর বসে পড়ে। অর্থাৎ একতরফা সম্পর্ক যেন না হয়। এ সম্পর্ক রক্ষায় দুই পক্ষেরই পেশাদারিত্ব থাকা দরকার। সম্পর্ক তিক্ততার দিকে নেওয়া ঠিক হবে না এ কারণে যে, এর প্রভাব বাংলাদেশের মানুষের জন্যই খারাপ হবে।
আমরা দেখেছি, মঙ্গলবার বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গেছেন। তিনি ইতিবাচক কথা বলেছেন যে, তারা অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করতে ইচ্ছুক। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়টিও তিনি বলেছন। কারণ বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক বহুমাত্রিক। একটি বিষয়ে দুই দেশের সম্পর্ক আটকে না রেখে দুই দেশের মানুষের সঙ্গে সংযোগ বাড়ানোর বক্তব্যও এসেছে। আমি মনে করি, এর মধ্যেই আলোচ্য সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত। কারণ ভারত ইতোমধ্যে পদক্ষেপও নিয়েছে।
তবে আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি মূল জায়গা। সংখ্যালঘুর জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করলেই কেবল পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা সহজ হবে। সে জন্য আমাদের সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু দ্বন্দ্বের অবসান জরুরি। যেমন সরকার বলছে, এখানে সংখ্যালঘুরা ভালো আছে। এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই ভারতেরও আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি দলকে আসার কথা বলা যাবে। তারা এসে যখন দেখবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক, তখনই এ সমস্যার সমাধান সহজ হতে পারে। তাদের কাউন্টার দেওয়া যাবে– আপনারা কেন এমন দাবি করছেন। তখন এই প্রতিনিধি দলও গিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলবে– না, সেখানে এ ধরনের নির্যাতন হচ্ছে না। সংখ্যালঘুরা ভালো আছে।
এভাবে ভারতের সঙ্গে আমাদের সমস্যার কূটনৈতিক সমাধানই সবচেয়ে ভালো বিকল্প। আমরা যদি এখনই সিদ্ধান্ত নিই– কোনো আমদানি-রপ্তানি হবে না, তাতে হয়তো আমরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবো। মনে রাখতে হবে, দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে অনেক মানুষের জীবিকা নির্বাহ হয়ে থাকে। সে জন্য ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
আমাদের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও উন্নয়ন ঘটাতে হবে, যাতে এখানে আন্দোলন হলেও ভারতের হাইকমিশন আক্রান্ত না হয়। মানুষের প্রতিবাদ জানানোর অধিকার আছে। তাই বলে হামলার মতো বাড়াবাড়ি করতে দেওয়া যাবে না। সংযম প্রদর্শনের মাধ্যমেই পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। সে জন্য সরকারের পাশাপাশি আমাদের রাজনীতিকরাও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবেন বলে আমার বিশ্বাস। আমাদের সঙ্গে কেউ বাড়াবাড়ি করলে সেটা ঠান্ডা মাথায় নিয়মমাফিক সমাধানের পথেই এগোতে হবে।
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ: প্রাক্তন অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়