সংস্কারের অনন্য সুযোগ যেন হাতছাড়া না হয়

ব্রাসেলসভিত্তিক গবেষণা সংস্থা আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) বলেছে,  স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতনের ফলে রাজনৈতিক সংস্কারের অনন্য সুযোগ এসেছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হলে দেশটি আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারে; এমনকি সামরিক শাসন আসতে পারে। অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকার যত বেশি সময় ক্ষমতায় থাকবে, আগাম নির্বাচনের আহ্বান ততই জোরালো হবে। এতে সরকারের বৈধতা নিয়ে সন্দেহ বাড়বে।

এ পরিস্থিতি এড়াতে জনসমর্থন ধরে রাখার ওপর জোর দিয়েছে আইসিজি। সংস্থাটির পরামর্শজনগণের মন দ্রুত জয়ের জন্য সরকারি সেবায় দুর্নীতি মোকাবিলা, বিদ্যুৎ সরবরাহের উন্নতি এবং দ্রব্যমূল্য কমানোর পদক্ষেপ নিতে হবে।  
অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন উপলক্ষে বৃহস্পতিবার রাতে 
বাংলাদেশে নতুন যুগ? সংস্কারের প্রথম ১০০ দিন শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে আইসিজি। সংস্থাটি বলেছে, আরও উচ্চাভিলাষী সংস্কারের জন্য জনসমর্থন বজায় রাখতে অন্তর্বর্তী সরকারের দ্রুত ফলাফল অর্জন করা উচিত। এ সরকারকে বেশি দিন ক্ষমতায় থাকা এড়িয়ে চলতে হবে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নতুন ব্যবস্থা নিয়ে ঐকমত্য গড়ে তুলতে হবে। বহিস্থশক্তির উচিত বাংলাদেশকে সাহায্য দেওয়া। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভাবমূর্তি মেরামতের জন্য কাজ করা উচিত ভারতের।

প্রতিবেদনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি, অনিয়ম, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থায় দলীয়করণ, নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করাসহ নানা বিষয় উঠে এসেছে। 
প্রতিবেদনে বলা হয়, ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, নির্বাচন ব্যবস্থা, দুর্নীতি প্রতিরোধসহ নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন খুব সহজ নয়। প্রতিবেদনে জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে নানা সংস্কার বাস্তবায়নে কিছু সুপারিশ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এতে বলা হয়েছে, জনগণের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা পূরণ করা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য রাজনৈতিক সংস্কার আনার অনন্য সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে অনেক বাধাও আছে। সংস্কার কর্মসূচির দিকে নজর দিতে চাইলে ড. ইউনূসকে রাজনৈতিক ঐকমত্য বজায় রাখতে হবে। বিভক্তির জায়গাগুলোতেও নজর  দিতে হবে। 
সরকারের ভেতরকার একজন যেমনটা উল্লেখ করেছেন, 
রাজনৈতিক পক্ষগুলো সংস্কার প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার মতো ধৈর্য ধারণ করতে পারলে এ মুহূর্তে সবকিছুই সম্ভব। তবে তাদের সংস্কারের প্রতি আগ্রহ আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। শেখ হাসিনা হাতেগোনা যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি, তার একটি সেনাবাহিনী। গত ৪ আগস্ট হাসিনার দেওয়া কারফিউ কার্যকর না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা। আর তাতে হাসিনার পরিণতি ঠিক হয়ে গিয়েছিল। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আলোচনায় সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সেনাপ্রধান কিংবা একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনীর মধ্যে রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা দেখা যায়নি। এক সাক্ষাৎকারে সেনাপ্রধান বলেছেন, যাই হোক না কেন, তিনি ড. ইউনূসের পাশে থাকবেন। যেন তিনি তাঁর লক্ষ্য (মিশন) পূরণ করতে পারেন।

একটি সরকারি সূত্র বলেছে, সেনাপ্রধান অত্যন্ত ক্ষমতাবান। তিনি তাঁর ক্ষমতা দেখান না, তবে কোনো না কোনোভাবে তিনিই এই সরকারকে টিকিয়ে রেখেছেন। আরেকটি বিষয় হলো, প্রশাসনিক অভিজ্ঞতায় ঘাটতি থাকা উপদেষ্টাদের সঙ্গে অভিজ্ঞ সহযোগী বা কর্মী যুক্ত করা, যা কাজে সহায়ক হতে পারে।
শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে ইসলামপন্থিদের বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী এবং হেফাজতে ইসলামের প্রভাব বেড়েছে। একটা সময় ছিল, যখন ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানকে সমর্থন দেওয়ায় বাংলাদেশিদের অনেকে জামায়াতকে ঘৃণা করত। কিন্তু এখন শেখ হাসিনা প্রশাসনের নিপীড়নের ভুক্তভোগী হিসেবে সহানুভূতি পাচ্ছে তারা। গত কয়েক বছরে দলটিকে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো প্রয়োজনীয় সেবা খাতগুলোয় মনোযোগ দিতে দেখা গেছে। অথচ রাষ্ট্রীয়ভাবে এ খাতগুলো অবহেলিত থাকে। এসব কাজের মধ্য দিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে সমর্থন বাড়িয়েছে জামায়াতে ইসলামী। হাসিনার শাসনকাল থেকে একটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো, দেশের রাজনৈতিক কাঠামো থেকে ইসলামপন্থি দলগুলোকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করাটা হিতে বিপরীত হতে পারে। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারকে দুর্বল করতে পারে, এমন পদক্ষেপ এড়াতে নয়াদিল্লির এখন সাবধানে পা বাড়ানো উচিত। বরং পানিবণ্টন চুক্তি, উন্নত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা এবং দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক চুক্তির পর্যালোচনার বিষয়ে নতুন আলোচনার প্রস্তাব দেওয়াসহ বাংলাদেশকে সমৃদ্ধি অর্জনে সাহায্য করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। যদি জনসমর্থন ধরে রাখতে না পারে, তাহলে এই সরকারকে হয়তো একটি আগাম নির্বাচন দিতে হবে। আর এটা হলে প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, রাষ্ট্রক্ষমতায় আসবে বিএনপি। তবে ক্ষমতায় গেলে দলটিকে হতে হবে সংযত। যদি শেষ পর্যন্ত এটা ঘটে (বিএনপি ক্ষমতায় আসে), তাহলে বাংলাদেশ আবারও লেজুড়বৃত্তি, পেশিশক্তি ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে যথেচ্ছ ব্যবহারের রাজনীতিতে ফিরে যাবে। এতে ঝুঁকির মুখে পড়বে দেশটির ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতা। পাশাপাশি রাষ্ট্রসংস্কারের বিরল যে সুযোগ এসেছে, তাও হাতছাড়া হয়ে যাবে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে, যদি বিদ্যমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি অরাজকতায় রূপ নেয়। এ ক্ষেত্রে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেনাবাহিনী হয়তো ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসবে। এতে দেশটিতে আবার সামরিক শাসন শুরু হতে পারে। তাই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব পক্ষের উচিত, এ রকম কিছু যাতে না ঘটে, সে বিষয়ে সজাগ থাকা।