অর্থনীতির নিরাময়ে বিনিয়োগ কর্মসংস্থানে জোর দিতে হবে
সংকটে থাকা অর্থনীতির নিরাময়ে এখন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং দৈনন্দিন জীবনে স্বস্তি নিশ্চিতে কাজ করতে হবে। গতকাল সোমবার ঢাকার হোটেল সোনারগাঁওয়ে তৃতীয় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্মেলনে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা অংশ নিয়ে এ কথা বলেন। ‘বৈষম্য, আর্থিক অপরাধ ও বাংলাদেশের অর্থনীতির নিরাময়’ শিরোনামে এ সম্মেলনের আয়োজন করে দৈনিক বণিক বার্তা।
সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশ পরিচালনায় অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যক্তিগত এজেন্ডা নেই বলে এ সরকারকে কিছু দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন আর্থিক খাতসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানিক ভিত্তি অনেক দুর্বল হয়ে গেছে। এসব কাটিয়ে উঠতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। স্বল্প ও মধ্য মেয়াদের কিছু কাজ বর্তমান সরকার করবে। তবে এমনভাবে করা হবে যাতে পরবর্তী সরকারও তা অব্যাহত রাখে। আর দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার এসে বাস্তবায়ন করবে।
তিনি আরও বলেন, এখন আয় বৈষম্যের তুলনায় সম্পদের বৈষম্য বেশি। ডিজিটাল বাংলাদেশ বললেও দুঃখজনক হলেও বাস্তব দেশ সেভাবে ডিজিটালাইজ হয়নি। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি না এলে কোনো কিছুই সম্ভব নয়।
বাণিজ্য এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের নবনিযুক্ত উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন বলেন, গত ৫ আগস্টেও দেশের অনেক ব্যাংক থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। দুই হাজার প্রাণের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা এসেছে, তা ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। তিনি আরও বলেন, এত দিন ব্যবসা যেভাবে রাজনীতিকীকরণ হয়েছে, তাতে মাঝে মাঝে ব্যবসায়ী পরিচয় দিতে লজ্জা হয়। শুধু দেশে ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নয়নে উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ব্যবসা পরিচালনার খরচ কমাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পণ্যের সরবরাহ বাড়ানো এবং সমন্বয়ের বিষয়ে গুরুত্ব দেবেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশের তথ্য পর্যালোচনা করে নীতি সুদহার বাড়ানোর পর ১২ মাস সময় লেগেছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসতে। বাংলাদেশে নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে চার মাস হলো। সে হিসাবে আরও আট মাস অপেক্ষা করতে হবে মূল্যস্ফীতি কমার জন্য। বন্যার কারণে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
গভর্নর আরও বলেন, গত তিন মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক টাকাও ছাপায়নি। এ ছাড়া তিন মাসে রিজার্ভ থেকেও কোনো ডলার বিক্রি করা হয়নি। বাজারে এখন ডলারের অভাব নেই। প্রথমে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে আসার দিকে মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে। স্থিতিশীলতা ফিরলেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসার পাশাপাশি বিনিয়োগ বাড়বে।
বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাত সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মন্তব্য করে আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, আর্থিক খাত সবচেয়ে দুর্বল, এমনকি পাকিস্তানের চেয়েও। আর্থিক খাতের দুর্বলতার ছাপ দেশের অর্থনীতিতে পড়েছে। এর জের টানতে হচ্ছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যে, এখন পর্যন্ত ভবিষ্যৎমুখী কিছু করা সম্ভব হয়নি; বরং অতীতের জের টানা ও সংশোধন করতে হচ্ছে। ব্যাংক থেকে যারা টাকা বের করে নিয়েছে, তাদের অর্থ ফেরত দিতে হবে। বিদেশে পাচার করা অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা জোরদার করা হয়েছে।
গভর্নর আরও বলেন, প্রতিদিনই বাংলাদেশ ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর নগদ অর্থপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ করছে। একটি ব্যাংক থেকে ২৩ হাজার কোটি টাকা যদি এক পরিবার নিয়ে যায়, তাহলে সেই ব্যাংকের কী থাকে! এসব ক্ষেত্রে নতুন কিছু করতে হবে। ব্যাংক রেজল্যুশন অ্যাক্ট করা হবে, যার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে সব ক্ষমতা চলে আসবে। ফলে ব্যাংক একীভূতকরণ, অধিগ্রহণসহ সবকিছুই করা সম্ভব হবে। কিছু ব্যাংকে পুঁজি সঞ্চার করা হবে। কিছু ব্যাংকে নতুন বিনিয়োগ নিয়ে আসতে হবে। তবে কোনো ব্যাংক বন্ধ হবে না।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও পিপিআরসির চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, বহুমাত্রিক সংকট ও বৈষম্যের শিকার অর্থনীতিকে উদ্ধারে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান এবং দৈনন্দিন জীবনের স্বস্তি নিশ্চিতে কাজ করতে হবে। ইতোমধ্যে সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও অন্যান্য ইস্যুতে উদ্যোগ তেমন দৃশ্যমান নয়।
তিনি আরও বলেন, দৃশ্যমান দুর্নীতি কমেছে, কিন্তু কাজের গতি আরও কমে গেছে। শুধু ঢাকায় বসে থাকলে হবে না, সরকারকে মাঠে নামতে হবে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে হয়রানি বন্ধ করতে হবে। টিআইবির দুর্নীতি নিয়ে সূচকের আদলে ভোগান্তি নিয়ে সূচক তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে তিনি জানান। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে তিনি বলেন, সরকার এখনও আমলাতান্ত্রিক মনিটরিংয়ের মধ্যে রয়েছে।
বিএনপি সরকারের দায়িত্ব নিলে জিডিপির ১০ শতাংশ স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, অর্থনীতির উন্নয়নে দেশে গণতান্ত্রিক জবাবদিহি থাকতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দেশে নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বের আওতায় বিনিয়োগ করতে চান। কারণ তারা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য এক ধরনের স্থিতিশীল পরিবেশ আশা করেন।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, সমাজে বহুমাত্রিক বৈষম্য বিদ্যমান। এ দেশে দুইভাবে সম্পদ সৃষ্টি হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য ও পরিশ্রমের মাধ্যমে এবং কোনো পরিশ্রম ছাড়াই। পরেরটা নিরুৎসাহিত করতে হবে। দেশে বিনিয়োগ করে দেশেই কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে উৎসাহিত করতে হবে। এ জন্য সুদহার সহনীয় পর্যায়ে রাখার পাশাপাশি অন্যান্য ব্যবসায়িক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। একটা দেশের রাজনীতি আর অর্থনীতি ‘ভাই ভাই’ বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, মূল্যস্ফীতি কমাতে গিয়ে এমন মুদ্রানীতি দিয়ে অর্থনীতির গলা টিপে ধরা ঠিক নয়।
এবিবির চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের সিইও সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, গত ১৫ বছর ব্যাংক খাতে অনিয়ম, অরাজকতা ও দুর্নীতির জোয়ার চলেছে। শেষ কয়েক বছরে যা সুনামির আকার ধারণ করে। তবে সুনামি প্রতিরোধ করা গেছে। ব্যাংক খাত আবার ঘুরে দাঁড়াবে। সিটি ব্যাংকের সিইও মাসরুর আরেফিন বলেন, আজব ব্যাপার হচ্ছে, এ দেশে দুই ধরনের ব্যাংক রয়েছে– সবল ও দুর্বল। কিছু ব্যাংকে প্রচুর তারল্য থাকলেও দুর্বল ব্যাংকগুলো সংকটে। দুর্বল ব্যাংকগুলো নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার দরকার।
ফিকি সভাপতি ও ইউনিলিভার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান জাভেদ আখতার বলেন, গত আট মাসে ভিয়েতনামে বিদেশি বিনিয়োগ ১৪ বিলিয়ন ডলার এলেও বাংলাদেশে ছয় মাসে এসেছে ১ বিলিয়ন ডলারের কম। বিনিয়োগ বাড়াতে বিশ্বাসযোগ্যতার পাশাপাশি নীতির ধারাবাহিকতা প্রয়োজন।
সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা, এমসিসিআইয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট নিহাদ কবির, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম, এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর হোয়ে ইউন জিয়ং, ইস্ট কোস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজম জে চৌধুরী প্রমুখ।