জবাবদিহিহীনতা
আবারও বেপরোয়া বাস চালানোর বলি হইল পাঁচটা তাজা প্রাণ। এইবারের ঘটনাস্থল বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার দ্বিতীয় বাইপাস সড়কের সুজাবাদ দহপাড়া এলাকা। শুক্রবার সমকালের এক প্রতিবেদন অনুসারে, বৃহস্পতিবার মধ্যাহ্নে বেপরোয়া গতিতে চলমান বাস একটা সিএনজিচালিত অটোরিকশাকে চাপা দিলে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। সড়ক দুর্ঘটনা লইয়া অদ্যাবধি প্রায় সকল গবেষণায় দেখা গিয়াছে, সড়ক-মহাসড়কে সংঘটিত অধিকাংশ দুর্ঘটনার প্রধান কারণ বেপরোয়া যান চালানো। কিন্তু দুঃখজনক, উহা নিয়ন্ত্রণে অদ্যাবধি দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা পরিলক্ষিত হয়নি সংশ্নিষ্ট সরকারি সংস্থগুলির পক্ষ হইতে।
যদি বলা হয়, সড়ক নিরাপত্তার প্রতি তাহাদের এহেন অপরাধজনক উদাসীনতারই শিকার হইলেন বগুড়ার ঐ সিএনজি যাত্রীগণ, তাহা হইলে নিশ্চয় কোনো অত্যুক্তি হইবে না। শুধুই কি বেপরোয়া গতি? সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞগণ প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার জন্য যান চালকদের প্রশিক্ষণহীনতা এবং যান চলাচলবিষয়ক আইন ও বিধি সম্পর্কে অজ্ঞতাকেও দায়ী করিয়া থাকেন।
আমাদের মনে আছে, বর্তমান সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ২০১১ সালে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের পর একাধিকবার স্বীকার করিয়াছেন, ভারী কিংবা হালকা অন্তত অর্ধেক সংখ্যক যানচালকের বৈধ লাইসেন্স ও প্রশিক্ষণ নাই। অর্থাৎ দেশের সড়ক-মহাসড়কে যাঁরা বাসসহ বিভিন্ন মোটরযান চালান, তাঁহাদের অর্ধেক সংখ্যক আনাড়ি। গত এক দশকেরও অধিক সময়ে এই ক্ষেত্রে উন্নতি হইয়াছে, বলা যায় না।
যদি হইত, প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকিত না- আলোচ্য ঘাতক বাসটা চালাইতেছিল চালকের সহকারী। কারণ চালক তখন যাত্রীর আসনে গভীর ঘুমে মগ্ন ছিলেন। এই যে চালক তাঁহার সহকারীকে স্টিয়ারিংয়ে বসাইয়া নিদ্রা যাইতেছিলেন, উহারই বা হেতু কী? প্রথমেই আসিবে তাঁহার দায়িত্বহীনতার কথা- আমরা জানি। তবে বিশেষত একটু দূরপাল্লার বাসের চালকদের যে প্রায়শ কোনো প্রকার বিশ্রাম ব্যতিরেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করিতে হয়, উহাও তো আমরা জ্ঞাত। আলোচ্য বাসচালক যে একই পরিস্থিতিতে একটু বিশ্রাম লইবার আশায় স্টিয়ারিংটা তাঁহার সহকারীকে ছাড়িয়া দেন নাই- উহাই বা কে জোর গলায় অস্বীকার করিবে?
যাহাই হউক, দেশের আর দশটা খাতের ন্যায় সড়ক পরিবহন খাতেও যে সরকারি সংস্থাগুলির জবাবদিহির লেশমাত্র নাই এবং ফলস্বরূপ পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতাদের স্বেচ্ছাচারিতার বলি হিসেবে প্রতি বৎসর ২০-২৫ সহস্র মানুষ নিহত-আহত হইতেছেন- উহা অস্বীকার করা কঠিন।
দুর্ভাগ্যজনক, গত কয়েক দশক ধরিয়া দেশে নিরাপদ সড়কের দাবিতে বহু আন্দোলন হইলেও কোনোটাই সরকারের নিদ্রাভঙ্গ হইতেছে না। ২০১৮ সালে একই দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সরকার অবশ্য একটু নড়িয়া-চড়িয়া উঠিয়াছিল। তারা একটা আইনও প্রণয়ন করিয়াছিল; যথায় অন্তত বেপরোয়া ও প্রশিক্ষণবিহীন চালক এবং মুনাফালোলুপ পরিবহন মালিকদের জন্য বেশ কড়া বার্তা ছিল। কিন্তু আন্দোলনটি নানা কারণে স্তিমিত হইবার পর মালিক-শ্রমিক নেতাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সংশোধনের নামে ঐ আইনটিও হিমাগারে প্রেরণ করা হইয়াছে।
তবে এই কথা বলা নিশ্চয় বাহুল্য হইবে না, সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় সরকারের অনীহার ফলস্বরূপ সংঘটিত বিভিন্ন প্রাণহানি প্রকৃতপক্ষে কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড। ইহার ফলে শুধু যে অসংখ্য পরিবার উহাদের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের চিরতরে হারাইতেছে, তাহাই নহে; দেশের অর্থনীতিও বহুভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছে। অধিকন্তু সড়কে চলাচল করিতে গিয়া যাঁহারা চিরতরে পঙ্গু হইতেছেন, তাঁহারাও স্বীয় পরিবারের পাশাপাশি রাষ্ট্রের জন্য এক প্রকার বোঝা হইয়া দাঁড়াইতেছেন। বর্তমান সরকার দেশকে অনূ্যন দুই দশকের মধ্যে উন্নত দেশের পর্যায়ে লইয়া যাইবার পরিকল্পনা করিয়াছে। কিন্তু পরিসংখ্যান দিয়া দেখানো যায়, যে দেশ যত উন্নত সে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা তত নিয়ন্ত্রিত।
আমাদের প্রত্যাশা, সরকারের নীতিনির্ধারকরা বিষয়টা অনতিবিলম্বে উপলব্ধি করিবেন এবং ইতোপূর্বে বারংবার উচ্চারিত সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার বিষয়ে তাঁহাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করিবেন।