সিপিডির সংলাপ শিগগিরই কাটছে না অর্থনৈতিক সংকট

বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট শিগগিরই কাটছে না। এই সংকট আরও দু-তিন বছর
থাকতে পারে। অর্থনৈতিক চাপ কমাতে সরকার এখন যে উদ্যোগগুলো নিচ্ছে, তা অপর্যাপ্ত
এবং স্বল্পমেয়াদি। সরকারকে মধ্য মেয়াদে সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখতে উদ্যোগ
নিতে হবে।
এ জন্য পাঁচটি বিষয়ে বিশেষ জোর দিতে হবে। সেগুলো হলো বৈদেশিক মুদ্রার
মজুত স্থিতিশীল রাখা, মূল্যস্ফীতি ব্যবস্থাপনা, রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক
কর্মকাণ্ডে গতি ধরে রাখতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং সামাজিক
নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বৃদ্ধি। এসব খাতে সংস্কার দরকার।
গতকাল রোববার বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ
(সিপিডি) ‘সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ: কতটা ঝুঁকি’
শীর্ষক সংলাপ ও মিডিয়া ব্রিফিংয়ের আয়োজন করে। সেখানে বর্তমান সামষ্টিক অর্থনীতি
বিশ্লেষণ করে এসব কথা বলেন বিশেষ বক্তারা। সিপিডির ধানমন্ডি কার্যালয়ে এই অনুষ্ঠান
হয়।
সেখানে সিপিডি বলছে, অর্থনীতি মধ্যমেয়াদি সংকটের মুখে পড়েছে। সবাইকে
সম্পৃক্ত করে অর্থনীতির চাপ মোকাবিলা করতে হবে। তবে অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতির
স্বীকৃতি দিয়ে সরকারের নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণকে সমর্থন করেছেন বক্তারা।
সার্বিক পরিস্থিতি বিশেষ করে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন
বলেন, দেশে এখন যে অর্থনৈতিক সংকট চলছে, তার চরিত্র স্বল্পমেয়াদি নয়। এই সংকট এখন
স্বল্পমেয়াদি থেকে মধ্যমেয়াদি হতে চলেছে এবং দীর্ঘ মেয়াদেও এর একটা রেশ রয়ে যাবে।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও এমন ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিদ্যমান সংকট কাটাতে দ্রুততম সময়ে
পদক্ষেপ নিতে নীতিনির্ধারকদের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
অনুষ্ঠানে বিষয়ভিত্তিক কয়েকজন বিশেষ বক্তা ছিলেন। সামষ্টিক অর্থনীতি
পরিস্থিতি নিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো.
আজিজুল ইসলাম, ব্যাংক খাত নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ,
আর্থসামাজিক খাত নিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং পাওয়ার অ্যান্ড
পার্টিসিপেশন রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর
রহমান, বহিঃখাত নিয়ে সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ
খাত নিয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ম তামিম এবং
ব্যবসায় পরিবেশ নিয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ
চৌধুরী বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার
গোলাম মোয়াজ্জেম।
ওপরের দিক ঝকমকে, ভেতর নড়বড়ে
সামষ্টিক অর্থনীতিকে ভবনের সঙ্গে তুলনা করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের
সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, গত কয়েক বছর সামষ্টিক অর্থনীতির
স্বস্তিদায়ক অবস্থার কথা বলা হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, ভবনের ওপরের দিক ঝকমকে,
ভেতরটা নড়বড়ে। এ দেশের অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ে অর্থাৎ ভেতরে-ভেতরে
নানা ধরনের সমস্যা আছে। শ্রীলঙ্কার ভেতরে অনেক সমস্যা ছিল।
গোষ্ঠীতন্ত্রের কারণে সময়মতো অনেক সিদ্ধান্ত নেয়নি শ্রীলঙ্কা। বাংলাদেশেও আমি
তেমন লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি। বাংলাদেশ ব্যাংক ‘দেখছি’,
‘দেখব’—এসবের মধ্যে আছে। তাঁর মতে, এই সংকট শিগগিরই কাটিয়ে ওঠা যাবে না।
ব্যাংক খাত নিয়ে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংক খাতে সুশাসন একটি বড়
সমস্যা। হোটেলে বসে সুদের হার পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে নির্ধারিত হয় না। কেন্দ্রীয়
ব্যাংকের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। যেমন এত আমদানি হলো, কিন্তু শিল্প খাতে এর
প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। ব্যাংক খাতের পরিচালকদের জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত। আবার
খেলাপি ঋণে বড় বড় ছাড় দেওয়া হচ্ছে। ঋণের টাকা ফেরত আসবে না। ফলে চাপ পড়ছে ছোট উদ্যোক্তাদের
ওপর। তিনি বলেন, খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২২ হাজার কোটি টাকা থেকে সোয়া ১ লাখ কোটি
টাকায় উন্নীত হয়েছে। ফাঁকফোকর না থাকলে এত খেলাপি ঋণ বাড়বে কীভাবে?
বর্তমান প্রেক্ষাপটে সালেহউদ্দিন আহমেদ কয়েকটি সুপারিশ করেন। সেগুলো
হলো সরকারি অর্থের অপচয় বন্ধ, অর্থ পাচার রোধ এবং ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায়
দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন নীতি অবলম্বন।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই প্রধান চ্যালেঞ্জ
বর্তমান প্রেক্ষাপটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে
মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল
ইসলাম। তাঁর মতে, বহির্বিশ্বের কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। তাই দেশের অভ্যন্তরে
সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম
বাড়লে দেশে চাহিদা কমবে, দাম কমবে না, যা সার্বিকভাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমিয়ে
দেবে। তিনি মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে গরিব মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার সুপারিশ করেন।
তাঁর মতে, মূল্যস্ফীতি বাড়লে বহু মানুষ গরিব হয়ে যায়।
এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, প্রবাসী আয় কমার অর্থ হলো প্রণোদনা
কার্যকর হচ্ছে না। আমদানি-রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচার হচ্ছে। কিন্তু এনবিআর কার্যকর
কোনো উদ্যোগ নিতে পারছে না।
আমদানিনির্ভরতায় বিদ্যুৎ খাতে সংকট
প্রাথমিক পণ্য তেলের অতিমাত্রায় আমদানিনির্ভরতার কারণে বিদ্যুৎ খাতের
এখন এই দশা বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার
জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ম তামিম। তিনি বলেন, তেলভিত্তিক
বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর মারাত্মকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় আজকের এই অবস্থা।
প্রাথমিক পণ্য হিসেবে দেশের অভ্যন্তরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান করা হয়নি।
পাঁচটি গ্যাসের কূপ খনন করতে ৫০০ কোটি টাকা লাগে। যদি না পাওয়া যায়—এমন
শঙ্কায় সরকার ঝুঁকি নিতে চায়নি। এই ঝুঁকি নেওয়ার রাজনৈতিক সাহস কেউ দেখাতে পারেনি।
আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের বাজারও স্থিতিশীল নয়। তিনি বলেন, ‘ইউক্রেন
যুদ্ধের অস্থিরতায় ইউরোপের দেশগুলো যদি রাশিয়া ছাড়া অন্য কোনো দেশের দিতে হাত
বাড়ায়, তাহলে অর্থনৈতিক সক্ষমতায় আমরা তাদের সঙ্গে পেরে উঠব না। এর মানে, ধীরে
ধীরে জ্বালানির প্রাথমিক পণ্য আমদানির উৎস সীমিত হয়ে আসছে। তাই বিদ্যুতের চাহিদার
বিষয়ে সাশ্রয়ী হতে হবে।’
অর্থনীতিতে তিন লৌহ ত্রিভুজ
আর্থসামাজিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অর্থনীতির কাঠামোগত সমস্যা
তুলে ধরেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন,
অর্থনীতিতে তিন লৌহ ত্রিভুজ গেড়ে বসেছে। প্রথমত, ক্ষমতাসীন ও প্রভাবশালীরা
একমাত্রিক উন্নয়নের দর্শন আটকে দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, স্বার্থের দ্বন্দ্বভিত্তিক
অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা তৈরি হয়েছে। আইনিভাবে অনিয়ম তৈরি করা হয়েছে। যেমন
গোষ্ঠীস্বার্থে ভাড়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্র অব্যাহত রাখা হয়েছে। তৃতীয়ত, এসব অবিচারের
খাটুনির বোঝা গরিব, স্বল্প ও সীমিত আয়ের মানুষের ওপর পড়ছে।
দুশ্চিন্তা থেকে যেন ভীতি না ছড়ায়
বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটে ‘দুশ্চিন্তা আছে’
বলে মনে করেন সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, এই দুশ্চিন্তা
থেকে যেন ভীতি না ছড়ায়। রিজার্ভ পরিস্থিতি সুসংহত করতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল
(আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখার পরামর্শ দেন তিনি। কারণ,
রিজার্ভ শুধু আমদানির ওপর চাপ সৃষ্টি করবে না, বিদেশি ঋণ পরিশোধেও শিগগির চাপ তৈরি
করবে। অর্থ পাচার রোধে ‘শূন্য’ সহিষ্ণুতা দেখানোর তাগিদ দেন তিনি।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০১৫ থেকে
২০২০ সালের মধ্যে রাজস্ব জিডিপি অনুপাত ১৪ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য ছিল। কিন্তু
এখনো তা ১ শতাংশের নিচে। রাজস্ব খাতে বড় সংস্কার লাগবে।
লোডশেডিংয়ের শিকার শিল্প খাত
এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেন, শিল্পকারখানায়
লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে। অথচ সরকারি তরফ থেকে বলা হচ্ছে, শিল্পকারখানায় লোডশেডিং হবে
না। কারণ, দেশের বেশির ভাগ শিল্পকারখানা ‘মিক্সড’
এলাকায় (আবাসিক এলাকায় শিল্পকারখানা)। লোডশেডিংয়ের কারণে শিল্প উৎপাদন ব্যাহত
হচ্ছে।
মোস্তফা আজাদ চৌধুরী আরও বলেন, রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত বাংলাদেশে
সবচেয়ে কম। দুর্নীতিকে প্রশ্রয় না দিলে এ দেশে রাজস্ব আদায় দ্বিগুণ হতো। উপজেলা
পর্যায়ে কর অফিস করতে হবে। প্রতিটি ইউনিয়নে বছরে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করেন—এমন
ব্যক্তিও আছেন। অথচ তাঁদের ব্যবসায় নিবন্ধন নেই। তাঁদের করের আওতায় আনতে হবে।







