গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’
বিভিন্ন পণ্যের বাড়তি দামের কারণে
এমনিতেই সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে স্বল্প আয়ের মানুষের। এরই মধ্যে নতুন করে
গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণে বিভিন্ন পণ্যের দাম আরও বেড়ে যেতে পারে। ফলে গ্যাসের
মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের কাছে ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’
দেখা দিয়েছে।
গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে জাগো নিউজের এই প্রতিবেদক বিভিন্ন
শ্রেণি-পেশার অন্তত ৫০ জনের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের প্রত্যেকেই গ্যাসের দাম বাড়ানোর
বিরোধিতা করেন। সবাই ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
তারা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাধার পর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে গেছে।
চাল, ডাল, তেল, চিনির বাড়তি দামের কারণে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এর সঙ্গে
সাবান, শ্যাম্পু, সবধরনের বেকারি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি আরও
চাপ বাড়াবে।
অন্যদিকে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বৈশ্বিক কারণে বর্তমানে বিভিন্ন
পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এখন গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন পণ্যের দাম আরও
বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে গ্যাসের এই মূল্যবৃদ্ধির কারণে নিম্ন আয়ের
মানুষের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে। তাদের বাজেটে (খরচ) কাটছাঁট করতে হবে।
তারা বলছেন, বর্তমানে সরকার গ্যাসের দাম না বাড়িয়ে ভর্তুকি দিয়ে
পরিস্থিতি সামাল দিতে পারতো। যেহেতু গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে, তাই অদূর ভবিষ্যতে
যেন আবার দাম বাড়াতে না হয়ে সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। সিস্টেম লস কমিয়ে
আনতে হবে।
গতকাল রোববার ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ অ্যানার্জি
রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবু ফারুক পাইপলাইনের
গ্যাসের পাইকারি মূল্য ৯ টাকা ২০ পয়সা থেকে ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ বাড়িয়ে ১১ টাকা ৯১
পয়সা করার ঘোষণা দেন। চলতি জুন মাস থেকেই কার্যকর হবে।
পাইকারিতে দাম বাড়ানোর পাশাপাশি যানবাহনে ব্যবহারের সিএনজি বাদে খুচরা পর্যায়েও
গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে বাসাবাড়ির দুই চুলার (ডাবল বার্নার) মাসিক বিল ৯৭৫
থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ৮০ টাকা করা হয়েছে। এক চুলার মাসিক বিল ৯২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে
করা হয়েছে ৯৯০ টাকা।
প্রিপেইড মিটারে প্রতি ইউনিটের খুচরা মূল্য ১২ টাকা ৬০ পয়সা থেকে
বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৮ টাকা। বাণিজ্যিক গ্রাহকদের (হোটেল, রেস্তোরাঁ) ক্ষেত্রে প্রতি
ইউনিটের দাম ২৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৬ টাকা ৬৪ পয়সা করা হয়েছে।
এছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৪ টাকা ৪৫
পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৫ টাকা ২ পয়সা, ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ১৩ টাকা ৮৫ পয়সা
থেকে বাড়িয়ে ১৬ টাকা, সার কারখানার জন্য ৪ টাকা ৪৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৬ টাকা করা
হয়েছে।
বৃহৎ শিল্পে প্রতি ঘনমিটার গ্যাস ১১ টাকা ৯৮ পয়সা, মাঝারি শিল্পে
১১ টাকা ৭৮ পয়সা এবং ক্ষুদ্র শিল্পে ১০ টাকা ৭৮ পয়সা হয়েছে। যা আগের ছিল শিল্প
কারখানার জন্য ১০ টাকা ৭০ পয়সা। আর সিএনজি স্টেশনে গ্যাসের দাম আগের মতোই প্রতি
ঘনমিটার ৪৩ টাকা রাখা হয়েছে।
গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিষয়ে মতিঝিলের একটি বিমা কোম্পানির কর্মকর্তা
মো. নাসিম বলেন, বাজারে চাল, ডাল, তেল, মাছ, মুরগী, চিনি, আলু, ডিমসহ সবকিছুর দাম
বাড়তি। সম্প্রতি সাবান, শ্যাম্পু, রুটি, বিস্কুটসহ সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে।
নিত্যপ্রয়োজনী পণ্যের বাড়তি দামের কারণে এমনিতেই সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
এর মধ্যে গ্যাসের জন্য বাড়তি খরচ আমাদের মতো স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য ‘মড়ার
উপর খাঁড়ার ঘা’।
তিনি বলেন, মাসপাঁচেক আমাদের বাসার গ্যাস মিটার সিস্টেম করে
দিয়েছে। এতে গ্যাসের খরচ কিছুটা কমে এসেছিল। কিন্তু এখন প্রি-পেইড মিটারের গ্যাসের
এক লাফে প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এটা কোনোভাবেই যুক্তিসংগত না।
খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা মো. মাইন বলেন, এতদিন দুই চুলার গ্যাসের বিল
দিয়েছি ৯৭৫ টাকা। আমার হিসেবে গ্যাসের এই বিল অনেক বেশি। এখন তা বাড়িয়ে ১০৮০ টাকা
করা হলো। অর্থাৎ গ্যাস বিল বাবদ মাসে আরও ১০৫ টাকা বেশি দিতে হবে। আমাদের তিনজনের
সংসারে যে গ্যাস ব্যবহার তার মূল্য কিছুতেই এতো হতে পারে না। গ্যাসের চুলা না
জ্বালালেও মাসে এই বিল দিতে হবে।
তিনি বলেন, গ্যাসের দাম বাড়িয়ে সরকারের উচিত চুরি বন্ধ করা। সাধারণ
মানুষের কাছ থেকে যে পরিমাণ গ্যাসের বিল নেওয়া হয়, প্রকৃতপক্ষে তার থেকে কম
মূল্যের গ্যাস ব্যবহার হয়। কিন্তু গ্যাস চুরি বন্ধ না করে বারবার গ্যাসের দাম
বাড়ানো হচ্ছে। এতে আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে ভুগতে হচ্ছে।
গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ফলে কি ধরনের প্রভাব পড়তে পারে জানতে চাইলে
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবি মির্জ্জা আজিজুল
ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, সরকার হয়তো ভর্তুকি কমানোর জন্য গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে। এর
ফলে সাধারণ মানুষের বাজেটের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে। এমনিতে দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে
মানুষের সংখা বেড়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণে নতুন করে বিভিন্ন পণ্যের দাম
বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যেহেতু গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েই গেছে, অদুর ভবিষ্যতে
যেন আবার দাম বাড়াতে না হয় সেজন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। অবৈধ যেসব সংযোগ আছে তা
চিহ্নিত করে লস কমিয়ে আনার ব্যবস্তা করতে হবে।