রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতির আশঙ্কা
মার্চ থেকে জুন-এই চার মাসে
লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৫৪২ কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ করতে হবে। এ
হিসাবে প্রতিদিন আদায় করতে হবে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা, যা অর্জন কঠিন বলে মনে
করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাজস্ব আহরণ এবং আগামী চার মাসে
আদায়ের অঙ্ক বিশ্লেষণে অর্থবছরের শেষে বড় ধরনের ঘাটতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ
পরিস্থিতিতে আদায়ের গতি বাড়াতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য ও সংশ্লিষ্ট
দপ্তরপ্রধানকে যথাযথ মনিটরিংয়ের নির্দেশ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি
অনুষ্ঠিত মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সমন্বয় সভায় এ নির্দেশ দেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
সূত্র জানায়, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের
সভাপতিত্বে বৈঠক হয়েছে। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সংশ্লিষ্ট
সবাইকে অধিকতর সচেষ্ট হতে হবে’।
বৈঠকে চলতি
অর্থবছরের (২০২১-২২) প্রথম আট মাস জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাজস্ব আহরণের
চিত্র তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যায়, প্রথম আট মাসে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১
লাখ ৯৯ হাজার ৯৪৯ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। একই সময়ে আদায় হয়েছে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৪৫৮ কোটি
৪৬ লাখ টাকা। এ সময় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার
৪৯১ কোটি ২৩ লাখ টাকা। যদিও গত অর্থবছরে একই সময়ে রাজস্ব আদায়ের হিসাবে বেশ এগিয়ে
এনবিআর। গত বছর ওই সময়ে আদায় হয়েছিল ১ লাখ ৫৩ হাজার ১০৪ কোটি ১০ লাখ টাকা।
জানতে
চাইলে সাবেক সিনিয়র অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে
রাজস্ব আহরণ খুব বেশি খারাপ হয়েছে বলে আমি মনে করি না। তবে সার্বিক দিক থেকে এটি
সন্তোষজনক নয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অতীতে কোনো সময় লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে
পারেনি। তিনি মনে করেন, রাজস্ব বাড়াতে কাঠামোগত সংস্কার দরকার। এতে কর বাড়ানো
সম্ভব। এছাড়া রাজস্ব আহরণ জিডিপির তুলনায় অন্যান্য দেশের চেয়ে আমাদের কম। সরকারকে
এখন এদিকে নজর দিতে হবে।
রাজস্ব
আদায়ে একটি বড় ক্ষেত্র হচ্ছে প্রকল্প। সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত
প্রতিবেদনে দেখা যায়, জুলাই-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হার ৩৫
দশমিক ৮০ শতাংশ। প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি কম থাকায় এ খাত থেকে রাজস্ব আহরণ কমছে।
ইউক্রেন-রাশিয়া
যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভোজ্য তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম
অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়, যা ভোক্তা পর্যায়ে অসহনীয় হয়ে ওঠে। মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে
উৎপাদন ও ভোক্তা পর্যায়ে ভোজ্য তেলের ওপর মোট ২০ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়।
সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এ বিষয়ে এক আদেশ জারি করেছে। আগামী ৩০ জুন
পর্যন্ত এই আদেশ বহাল থাকবে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এ
খাতে রাজস্ব আদায় কমবে। এমনকি চলতি বছরের শেষে রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতির আশঙ্কা
রয়েছে। এই ঘাটতি আরও বড় করবে ভোজ্য তেল আমদানি ও উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট মওকুফ।
অপরদিকে
চিত্র হচ্ছে-এই যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জ্বালানি তেলের মূল্য ১৩৯
মার্কিন ডলারের ওঠে। যদিও বর্তমানে ১০০ ডলারের নিচে নেমে এসেছে। তবে উচ্চমূল্যে
সরকারকে শুল্ক পরিশোধ করেই দেশে জ্বালানি তেলে আমদানি করতে হচ্ছে। এ খাতে শুল্ক
বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপণ্যের পাশাপাশি পোশাক, চামড়াসহ
বিভিন্ন শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল এবং মধ্যবর্তী পণ্যের দামও বেড়েছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে পোশাকের অন্যতম কাঁচামাল সুতার দামও বেশ চড়া। বেশকিছু পণ্যের
ট্যারিফ মূল্য অনেক কম ছিল। যেমন: খেজুর, ফল, কম্বল, সুতা, পলিপ্রোপাইলিন প্রভৃতি।
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম যাচাই-বাছাই করে এসব পণ্যের ট্যারিফ মূল্য বাড়ানো হয়।
বাড়তি ট্যারিফ মূল্যেই এখন শুল্ক-কর আদায় করা হচ্ছে। তবে এসব খাত থেকে শুল্ক আদায়
বাড়বে-এমনটি প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
রাজস্ব
প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর যুগান্তরকে
বলেন, ভোজ্য তেলের ওপর ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে। এতে রাজস্ব আয়ে কিছুটা ক্ষতি
হবে। তবে বিশ্ববাজারে এখন পণ্যের দাম অনেক বেশি। ফলে এতে আমদানি খাত থেকে আদায়
বাড়বে। এতে এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে।
প্রতিবেদন
থেকে জানা যায়, জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শুল্ক আহরণ হয় প্রায় ৫৬ হাজার ৯৫৭
কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের তুলনায় সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা বেশি। এটি
লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অর্জনের হার ৮৯ দশমিক ৬২ শতাংশ। একই সময়ে স্থানীয় পর্যায়ে
মূসক বা ভ্যাট বাবদ এনবিআর সংগ্রহ করেছে ৬৬ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা। এ খাতে প্রবৃদ্ধি
হয়েছে ১১ দশমিক ৪৮ শতাংশ। তবে এটি লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অর্জনের হার ৮৬ দশমিক ৪২
শতাংশ। একইভাবে আয়কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার ৮৯ দশমিক ১৪ শতাংশ অর্জন হয়েছে। টাকার
অঙ্কে ৫৯ হাজার ৮০০ কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও হয়েছে ৫৩ হাজার ৩০৮ কোটি
টাকা।