অর্থনীতির সমান তালে এগোতে পারেনি বীমা

 গত ৫০ বছরে দেশের অর্থনীতি যতটুকু এগিয়েছে, বীমাশিল্প সেভাবে এগোতে পারেনি। বর্তমানে দেশে ৪৬টি সাধারণ ও ৩২টি জীবন বীমা কোম্পানি রয়েছে। কিন্তু প্রতি এক হাজার মানুষের মধ্যে মাত্র চারজনের বীমা রয়েছে। প্রায় সাড়ে ১৭ কোটি জনসংখ্যার তুলনায় যা খুবই নগণ্য। অন্যদিকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও সম্পদ যতটা বেড়েছে তার বিপরীতেও বীমা কম। অধিকাংশ ব্যবসা ও ভবন বীমার আওতায় নেই। এ পরিপ্রেক্ষিতে আগামী দিনে দেশে বীমা খাতের বেশ সম্ভাবনা দেখছেন সংশ্নিষ্টরা।

জানা গেছে, বিভিন্ন বিধিমালা প্রণয়ন, কমিশন কমানো, প্রবাসী কর্মীদের জন্য বাধ্যতামূলক বীমা সুবিধা চালু, জীবন বীমার তামাদি পলিসি চালুর নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। এছাড়া যানবাহন বীমা নতুন করে সাজানো হয়েছে, যা বাধ্যতামূলক করা হবে। প্রণীত হয়েছে বীমানীতি-২০১৪। এসব সংস্কার উদ্যোগের ফলে বীমা খাতে স্বচ্ছতা আসছে। তবে আরও কাজ করতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বীমার প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ানো। বীমা যে ব্যক্তি বা সম্পদের নিরাপত্তা দেয়, তা কথায় না বলে কাজে প্রমাণ করতে হবে। এজন্য সরকারকে আইন প্রয়োগে যেমন কঠোর হতে হবে, তেমনি নীতিসুবিধাও দিতে হবে। পাশাপাশি বীমা কোম্পানিগুলোকে লেনদেন ব্যবস্থার উন্নয়ন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা বজায় রাখা, জনবলের দক্ষতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।

এশিয়া ইন্সুরেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইমাম শাহীন বলেন, বীমা খাতে সমস্যা যেমন আছে, সম্ভাবনা রয়েছে তার চেয়ে বেশি। অর্থনীতির স্বার্থেই বীমা খাত এগিয়ে নিতে হবে। নতুবা অগ্রগতি টেকসই হবে না। তিনি বলেন, সুশাসনের ঘাটতি, দক্ষ জনবলের অভাব, বীমা গ্রাহকদের মানসিকতাসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে বীমা খাত তেমন এগোচ্ছে না। এসব সমস্যা সমাধানে বীমা প্রতিষ্ঠান, বীমা গ্রাহক, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সরকারকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। ডিজিটাইজেশন বা স্বয়ংক্রিয় কার্যক্রম দরকার। দরকার দক্ষ জনবল। এজন্য নীতিসুবিধা দিতে হবে সরকারকে। পাশাপাশি বীমা প্রতিষ্ঠানের ভেতরের পরিবেশ উন্নয়নে উদ্যোক্তাদের উদ্যোগ নিতে হবে।

সামগ্রিক অর্থনীতি ও বীমা: 


বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতিতে বীমার অবদান অনেক। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতি যতটা এগিয়েছে সে অনুযায়ী বীমা খাত এগোয়নি। ফলে অর্থনীতিতে বীমার অবদানও কম। বীমানীতিতে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্যের জিডিপিতে বীমা খাতের অবদান ১১ দশমিক ৮ শতাংশ। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রে ৮ দশমিক ১ শতাংশ, জাপানে ৮ দশমিক ১ শতাংশ, হংকংয়ে ১১ দশমিক ৪ শতাংশ, চীনে ৩ শতাংশ, ব্রাজিলে ৩ দশমিক ২ শতাংশ, ভারতে ৩ দশমিক ১ শতাংশ ও সিঙ্গাপুরে ৭ শতাংশ। বাংলাদেশের জিডিপিতে বীমার অবদান মাত্র শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ। এর মধ্যে জীবন বীমার অবদান শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ এবং সাধারণ বীমার অবদান শূন্য দশমিক ২ শতাংশ। বাংলাদেশে প্রতি হাজারে মাত্র চারজনের জীবন বীমা রয়েছে। অর্থাৎ বেশিরভাগ জীবন ও সম্পদ বীমার আওতায় আসেনি।

চালু হচ্ছে ব্যাংকাসুরেন্স: 


এটি ব্যাংকের মাধ্যমে বীমাপণ্য বাজারজাত করার একটি স্বীকৃত ব্যবস্থা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ব্যবস্থা থাকলেও বাংলাদেশে চালু হয়নি। সম্প্রতি ব্যাংকাসুরেন্সের প্রবর্তন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে একটি অবস্থান পত্র। এ ব্যবস্থায় ব্যাংক বা ব্যাংকের শাখা অফিস বীমা কোম্পানির এজেন্ট হিসেবে কাজ করবে। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকাসুরেন্স চালু হলে বীমাপণ্য বিতরণ সহজ হবে এবং খরচও কম হবে। এ বিষয়ে মেটলাইফ বাংলাদেশের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এম আলা উদ্দিন আহমদ সমকালকে বলেন, বাংলাদেশের ব্যাংকাসুরেন্সের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, দেশের ব্যাংকগুলোতে কোটি কোটি গ্রাহক আছেন। আবার ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থাও বেশি। ফলে ব্যাংকের মাধ্যমে বাজারজাত করা হলে বীমা কোম্পানি সহজে গ্রাহক পাবে। অন্যদিকে ব্যাংকগুলোর নন-ফান্ডেড আয়ও বাড়বে।

আসছে সর্বজনীন স্বাস্থ্য বীমা: 


সরকার দেশের সকল মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা চিন্তা করে সর্বজনীন স্বাস্থ্যবীমা চালুর চিন্তা করছে। বর্তমানে চালু করা হয়েছে 'বঙ্গবন্ধু সুরক্ষা বীমা'। এতে ১০০ টাকার কম প্রিমিয়াম দিয়ে এক বছরের জন্য ২ লাখ টাকার চিকিৎসা সুবিধা পাওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। এ বীমার আওতায় বর্তমানে দুর্ঘটনাজনিত পঙ্গুত্ব, মৃত্যুর জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে। রাষ্ট্র খাতের বীমা প্রতিষ্ঠান সাধারণ বীমা করপোরেশন এ বীমা চালু করেছে। বেসরকারি খাতে এ বীমা চালু হয়েছে। এই বীমাকে সর্বজনীন করার পরিকল্পনা নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। প্রথমে স্বেচ্ছাধীন করা হলেও এক পর্যায়ে এই বীমা করা বাধ্যতামূলক করা হবে। অন্যদিকে স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের জন্য বঙ্গবন্ধু শিক্ষা বীমা চালু করা হয়েছে। বর্তমানে ৭০টি স্কুলে পরীক্ষামূলকভাবে এ বীমা চলছে।

সম্ভাবনা: 

বাংলাদেশে এখনও কৃষি বীমা, সর্বজনীন স্বাস্থ্য বীমা, দুর্যোগ বীমা নেই। অনেক সুউচ্চ ভবন, বড় বড় প্রকল্প বীমার বাইরে রয়েছে। শিক্ষা বীমা এবং প্রবাসীদের বীমা নিশ্চিত করেও এ খাতের সম্প্রসারণ সম্ভব। এছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য বীমা চালু করা যেতে পারে। রয়েছে পাবলিক পেনশন বীমা করার সুযোগ। এতে অর্থনীতিতে তহবিল সরবরাহ বাড়াবে। বীমা কোম্পানি অবকাঠামো খাতের বিনিয়োগে নিরাপত্তা দেবে, যা অবকাঠামো উন্নয়ন কার্যক্রম গতিশীল করবে। এছাড়া পুনঃবীমার বাজারকেও সম্প্রসারণ করতে হবে।

যা করা দরকার: 

সংশ্নিষ্টরা মনে করেন, বীমা খাতে কমিশন দেওয়ার ক্ষেত্রে অনৈতিক চর্চা বন্ধ করতে হবে। এছাড়া সময়োপযোগী বীমা পণ্য দরকার। আকর্ষণীয় বীমাপণ্যের অভাবও এ খাতের অন্যতম দুর্বলতা। বীমার প্রতি মানুষের আস্থা বাড়াতে শক্তিশালী আইনি কাঠামো, সচেতনতামূলক প্রচারণা দরকার। এক্ষেত্রে বীমা কোম্পানির পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ দরকার। ব্যাংকের মাধ্যমে বীমাপণ্য বাজারজাত করা জরুরি। দরকার ই-ইন্সুরেন্স চালু করা। এতে স্বচ্ছতা বাড়ার পাশাপাশি মানুষের আস্থাও বাড়বে।